অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রা, স্বপ্ন নাকি মৃত্যুর ফাঁদ?
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:৪৩ অপরাহ্ন, ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রজ্ঞা দাস, ইডেন মহিলা কলেজ: স্বপ্ন মানুষকে বাঁচতে শেখায়, স্বপ্ন মানুষকে সামনে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। কিন্তু যখন সেই স্বপ্ন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তখন সেটি আর স্বপ্ন থাকে না, হয়ে ওঠে বিভীষিকা। ইউরোপের স্বপ্ন অনেকের কাছেই সোনার হরিণের মতো। উন্নত জীবন, উচ্চ আয়, সামাজিক নিরাপত্তা এসব আকর্ষণ করে হাজারো মানুষকে। কিন্তু বৈধ পথে ইউরোপে যাওয়া সহজ নয়। দীর্ঘসূত্রিতা, খরচ এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে প্রতিদিন অসংখ্য বাংলাদেশি তরুণ অবৈধ পথে পা বাড়ান। তারা বিশ্বাস করেন, একটু কষ্ট করলেই পৌঁছে যাবেন স্বপ্নের ইউরোপে। কিন্তু তারা জানেন না, যে পথটি বেছে নিয়েছেন, সেটি কেবল অনিশ্চয়তা, প্রতারণা আর মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।কেউ কেউ ভাগ্যক্রমে ইউরোপে পৌঁছান বটে, কিন্তু সেখানেও অপেক্ষা করে এক অনিশ্চিত জীবন, যেখানে নেই নিরাপত্তা, নেই স্থায়িত্ব।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনের জন্য বিভিন্ন পথ ব্যবহার করা হয়। একটি সাধারণ পথ হলো ঢাকা থেকে আকাশপথে দোহা বা মিসর হয়ে লিবিয়া, এরপর সাগরপথে ইতালি।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০% বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশী এই পথ ব্যবহার করেন। এছাড়া ঢাকা-তুরস্ক-গ্রিস-আলবেনিয়া-কসোভো-সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া-হাঙ্গেরি-অস্ট্রিয়া-জার্মানি পথও ব্যবহৃত হয়। এই পথগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং দীর্ঘ।ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবি, পাচারকারীদের হাতে নির্যাতন, এবং বিভিন্ন দেশে আটক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অনেকেই গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। যারা পৌঁছান, তাদের অনেকেই বৈধ কাগজপত্রের অভাবে চাকরি পান না এবং অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। পুলিশের ভয়ে থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬২,৫৮৩ জন বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছেছেন। তবে এই যাত্রা সবসময় সফল হবে এর কোন নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ২,২৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
ইউরোপের সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্সের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৬,০০০-এর বেশি বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে আটক হয়েছেন।এত বিপদ জানার পরও তরুণরা প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই বিপজ্জনক যাত্রায় পা বাড়ান, এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। তবে অন্যতম কারণ ইউরোপ আসলে অনেকের কাছেই মরীচিকা।
অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্বে জর্জরিত হয়ে অনেকেই পা বাড়ান এই অনিশ্চিত গন্তব্যে।ইউরোপে গেলে তারা বেশি আয় করতে পারবেন, সংসার সুন্দরভাবে চালাতে পারবেন এই ধারণা তাদের প্রলুব্ধ করে। শুধু তাই নয় দেশে কর্মসংস্থানের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি ও নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে বিদেশমুখী করে তুলছে। তাছাড়া আমাদের সমাজে অনেকেই বিদেশে যাওয়া মানেই "সফলতা"মনে করেন।
কেউ যদি ইতালি বা ফ্রান্সে গিয়ে টাকা পাঠান, তবে তিনি গর্বের প্রতীক হয়ে ওঠেন। এই সামাজিক চাপে অনেক তরুণই সত্য-মিথ্যা না বুঝে দালালের ফাঁদে পা দেন। দালাল ও পাচারকারীরা এসব তরুণদের মিথ্যা প্রলুভন দেখায় উন্নত জীবনের। দালাল চক্রের সদস্যরা তরুণদের বোঝায় তাদের দলে অনেক লোক আছে "ইতালি পৌঁছালে তিন মাসের মধ্যে বৈধ কাগজপত্র হয়ে যাবে" বা "তুরস্ক থেকে ফ্রান্স পৌঁছানো খুব সহজ"। কিন্তু বাস্তবে যারা এই পথে যান, তাদের অনেকেই বছরের পর বছর অত্যাচার, নির্যাতনে দাসত্বের মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।অনেক বাংলাদেশি দালালের কথায় সাহারা মরুভূমি পাড়ি দিয়ে লিবিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করেন।
প্রচণ্ড গরম, খাবার ও পানির অভাব, ডাকাতের হামলা এসবের কারণে শত শত মানুষ পথে মারা যান। আবার লিবিয়ার বন্দিশিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়, মুক্তিপণ দাবি করা হয়, এমনকি অনেককে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাছাড়া ইউরোপে যেতে হলে অভিবাসীদের ছোট নৌকায় উঠে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয়। এসব নৌকায় ৫০-৬০ জনের ধারণক্ষমতা থাকলেও পাচারকারীরা তাতে ১৫০ থেকে ২০০ জন তুলে দেন। ফলে মাঝপথে নৌকাডুবি হয়, আর যাত্রীরা ডুবে মারা যান।
যারা বেঁচে থাকেন, তাদের জন্যও ইউরোপের জীবন খুব সহজ নয়।অবৈধ অভিবাসীরা কোনো নাগরিক সুবিধা পান না, চাকরি পান না, পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়।অনেকে নির্মাণ শ্রমিক বা কৃষিকাজে যুক্ত হন, যেখানে তাদের বেতন কম এবং কাজের পরিবেশ অমানবিক।দীর্ঘ অনিশ্চয়তা, পাচারকারীদের নির্যাতন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা এসব কারণে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পরেন।অবৈধ অভিবাসন দেশের এবং দেশের মানুষ উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। এটি দেশের মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।
পাশাপাশি দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করে এবং বৈদেশিক সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এই অবস্থা প্রতিকার এবং প্রতিরোধে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।অবৈধ অভিবাসনের ঝুঁকি সম্পর্কে প্রচারের মাধ্যমে জনগণের ভেতরের সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।সোশ্যাল মিডিয়ায় দালালদের প্রচার বন্ধ করতে হবে।মানব পাচারকারীদের চিহ্নিত করে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে।বিদেশি বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তার সহায়তার মাধ্যমে দেশে চাকরির সুযোগ তৈরি করতে হবে।
বিদেশ যাওয়ার আগে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। বিদেশ যাওয়ার জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রিতা রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে অবৈধ অভিবাসীদের সহযোগিতা করার জন্য আরও সক্রিয় হতে হবে। অবৈধ পথে ইউরোপ যাত্রা একটি মরীচিকা, যা প্রায়ই মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়।অবৈধ পথে ইউরোপ যাওয়া মানেই নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখা দোষের কিছু নয়, তবে সেটি যদি জীবনের বিনিময়ে হয়, তবে সেই স্বপ্নের কোনো মূল্য নেই। প্রত্যেকটি জীবন অমূল্য।বিদেশ যাওয়ার একমাত্র নিরাপদ পথ হলো বৈধ অভিবাসন।
দেশের কর্মসংস্থান ব্যবস্থার উন্নয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পাচারকারীদের দমন করতে পারলেই এই মরণ যাত্রা বন্ধ হতে পারে।জীবনের চেয়ে বড় কোনো স্বপ্ন নেই,এ সত্যটা বুঝতে হবে এবং এই মরণ ফাঁধের দিকে পা বাড়ানো থেকে সকলকে সচেতন হতে হবে।