‘গাছে বসবাস ও ডিম পাড়ছে গেছো শামুক: প্রজননে নতুন আচরণের সন্ধান’ — রাবির গবেষণা


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২:০৮ পিএম, ৮ই আগস্ট ২০২৫


‘গাছে বসবাস ও ডিম পাড়ছে গেছো শামুক: প্রজননে নতুন আচরণের সন্ধান’ — রাবির গবেষণা
ছবি প্রতিনিধি

মো. বিপ্লব উদ্দীন, রাবি প্রতিনিধি: ‘প্রকৃতির মুক্তা’ খ্যাত বিলুপ্তির মুখে থাকা গেছো শামুকের (অ্যামফিড্রোমাস গ্লোবোনেভিল্লি) প্রজনন বিষয়ে বিশ্বে প্রথমবারের মতো এক অভিনব আচরণ শনাক্ত করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গবেষকরা। 


গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রজাতিটি সম্পূর্ণরূপে গাছে বসবাস ও প্রজনন করে থাকে। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে বিস্তৃত অ্যামফিড্রোমাস প্রজাতির শামুকের ক্ষেত্রে এটাই প্রথমবারের মতো ডিম পাড়ার প্রামাণ্য তথ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।


সম্প্রতি এই আবিষ্কারটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ফোলিয়া মালাকোলজিকা (Folia Malacologica)-তে প্রকাশ পেয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার জীববৈচিত্র্য গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় ৫ দিনব্যাপী পরিচালিত মাঠ পর্যায়ের জরিপে এটি দেখা গেছে।


গবেষণায় নেতৃত্ব দেন রাবির মলাস্কান রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শাহরিয়ার শোভন এবং নেদারল্যান্ডস-এর ভ্রিজে ইউনিভার্সিটি (VU)-এর ড. তাকুমি সাইতো। 


দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন—মহালছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা টি এস রূপময় তঞ্চঙ্গ্যা, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের দুজন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. রহিম বাদশা ও মো. জায়িদ হাসান।


গবেষণায় উঠে এসেছে, অ্যামফিড্রোমাস গ্লোবোনেভিল্লি নামক গেছো শামুকটি গাছের ছোট ছোট গহ্বরে ১০ থেকে ৫০টি করে গোলাপি-সাদা ডিম পাড়ে। একই সঙ্গে কিছু ডিম শামুকের খোলসে লেগে থাকতে দেখা গেছে এবং কিছু ডিম গহ্বরের বাইরেও দৃশ্যমান ছিল। এই অভিনব আচরণ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, শামুকটির পুরো জীবনচক্রই গাছেই সম্পন্ন হয়, যা আগে কোথাও নথিভুক্ত হয়নি।


এছাড়া শুধু আম গাছ নয়, কাঁঠালসহ অন্যান্য বৃক্ষেও এরা ডিম পাড়ে বলে গবেষকরা ধারণা করছেন। পূর্ববর্তী গবেষণায় যেখানে পাতার নিচে নেস্ট তৈরি করে ডিম পাড়ার তথ্য ছিল, এবার তা পরিবর্তন করে গাছের গহ্বরে ডিম পাড়ার আচরণ ধরা পড়েছে।


গবেষণায় সহযোগী প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. রহিম বাদশা (সোহান) জানান, ‘বাংলাদেশে ফিল্ড-ভিত্তিক গবেষণা এখনো সীমিত; বেশিরভাগ গবেষণা কেবল প্রকাশনা ও ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরে কেন্দ্রীভূত। এই ধারা ভেঙে শাহরিয়ার শোভন স্যার জাপানি কোলাবরেটরের সহযোগিতায় বিরল প্রজাতির শামুক নিয়ে গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। 


ইতোমধ্যে পাঁচটি নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং একটি অনন্য আচরণগত পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। আরও গবেষণা ও প্রকাশনা প্রক্রিয়াধীন। তবে ফান্ডিংয়ের অভাবে এমন উদ্যোগ ব্যাহত হতে পারে। তাই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যথাযথ অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি বলে জানিয়েছেন মো. রহিম বাদশা।


এ বিষয়ে প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহরিয়ার শোভন বলেন, ‘বিশ্বে এ ধরনের শামুকের প্রজাতি অত্যন্ত বিরল। এটি খুবই চ্যালেঞ্জিংও বটে, অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির গহ্বরে বিপুলসংখ্যক ডিম একসঙ্গে রাখা। আমরা পাঁচজন গবেষক মিলে এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেছি। গেছো শামুকের প্রজনন আচরণ সংক্রান্ত এই প্রামাণ্য তথ্য সংরক্ষণনীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার স্থলচর গ্যাস্ট্রোপডের আচরণগত বিবর্তন ও বাস্তুতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য চিহ্নিত করতেও এটি সহায়ক হবে।’


প্রসঙ্গত, প্রফেসর শোভনের নেতৃত্বাধীন মলাস্কান রিসার্চ ল্যাবরেটরি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে গেছো শামুকের পাঁচটি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করেছে এবং বিশ্বের প্রথম সফল কৃত্রিম প্রজনন গবেষণাও সম্পন্ন করেছে, যা এই বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর সংরক্ষণে যুগান্তকারী অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।