জাপায় দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব আরও বাড়ছে


Janobani

আজাহারুল ইসলাম সুজন

প্রকাশ: ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন, ৮ই মে ২০২৩


জাপায় দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব আরও বাড়ছে
রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। ফাইল ছবি

নির্বাচন যতই কাছাকাছি আসছে, জি এম কাদের ও রওশন এরশাদকে ঘিরে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ততই দানা বাঁধছে। ওপরে ওপরে ঐক্যের কথা বলা হলেও রওশন এরশাদ ও গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে রয়ে গেছে দ্বন্দ্ব। দলীয় নানা কর্মসূচিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দুজনে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে।


সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মূলত দলটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভেতরকার এই বিরোধ । নেতৃত্ব নিয়ে দেবর-ভাবির মাঝে কোনো সমাঝোতা হয়নি। ওপরে ঐক্যের ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব আছে। যার প্রকাশ ঘটছে নানান ভাবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই বিরোধের অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দলের বাইরে থেকে। ফলে এই বিরোধ নিরসনের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন দলটির নেতাদের অনেকে।


জাপার গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেন, দলের কর্তৃত্ব, কমিটি গঠন ও প্রার্থিতা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ সামনে আরও প্রকাশ্য হতে পারে। নেতা-কর্মীদের বড় অংশটি এখন পর্যন্ত দলীয় চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকলেও একটা পক্ষ নির্বাচন সামনে রেখে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে ঘিরে তৎপর রয়েছেন। আবার অনেকে দুই দিকেই সম্পর্ক রেখে চলছেন।


জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। একসময়ের মহাসচিব ও সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে গতবছরের ১৪ সেপ্টেম্বর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে এবং দলটির উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে পৃথক দুটি নালিশি মামলাও হয় ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে।


জাপায় অভ্যন্তরীণ বিভাজন এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দুপক্ষের শীর্ষনেতারা পরস্পরকে দলের ‘কেউ না’ বলেও মন্তব্য করেছেন। জিএম কাদেরপন্থিরা বলছেন, তাদের অংশই পার্টির মূল। রওশন এরশাদের সঙ্গে যারা আছেন, তারা পার্টির কেউ না। আবার রওশনপন্থিদের অভিমত, পার্টির মূলধারার নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে আছেন। সুতরাং তারাই জাপার মূল অংশ। এই পক্ষ জিএম কাদেরপন্থিদের ‘প্রতারক’ বলেও মন্তব্য করেছেন ও কাদেরপন্থিরা তাদের ‘কেউ না’ বলে জানিয়েছেন।


সর্বশেষ ২০ মার্চ জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ৯৩ তম জন্মবার্ষিকী পালনকে কেন্দ্র করে আবারও তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। সেদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে জন্মবার্ষিকীর একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও রওশন এরশাদ তার পন্থীদের নিয়ে আয়োজন করে পৃথক অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে জাপা থেকে বহিষ্কৃত মসিউর রহমান রাঙা এবং জাপায় জিএম কাদেরের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করা জিয়াউল হক মৃধাসহ পার্টি থেকে বাদ পড়া নেতারা অংশ নেন।


জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অনেকের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকতেই দলে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভক্তি যেভাবে জিইয়ে ছিল, সেটা আগামীতেও থাকবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় জি এম কাদের কোনো কারণে সরকারবিরোধী অবস্থান নিলে, রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশ পাল্টা অবস্থান নেবে। আর এ ক্ষেত্রে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ যে সরকারের সঙ্গেই থাকবেন, তা তিনি বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যে বলেছেন।


দলটির নেতাদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ওই দুটি নির্বাচনে জাপাকে অংশ নিতে হয়েছিল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ না নেয়, সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে জাপার গুরুত্ব বেড়ে যাবে।


জি এম কাদেরের ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত হওয়ার পর তাঁর দল পরিচালনায় এখন সমস্যা না থাকলেও দলের ভেতরকার সংকট কাটেনি।


জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রওশনপন্থী অংশটি কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর এখন নতুন করে জাপার সম্মেলন অনুষ্ঠানে তোড়জোড় শুরু করেছে। তারা ২৩ এপ্রিল সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির একটি সভা করে। ওই সভায় রওশনপুত্র ও দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ প্রধান অতিথি ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে আগামী জুনের মধ্যে সম্মেলন করে কমিটি গঠন এবং সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের খসড়া তালিকা করার ঘোষণা দেওয়া হয়।


ইতিমধ্যে রওশনপন্থীরা ৪২টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করেছে। যদিও এসব কমিটির অধিকাংশ সদস্যই দলছুট বা বহিষ্কৃত নেতা। আবার দীর্ঘদিন রাজনীতিতে ছিলেন না, এমন সাবেক নেতাদেরও কমিটি রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।


জাপার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি রওশন এরশাদ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কাছে ২৪ জন নেতার একটি তালিকা পাঠিয়ে তাঁদের দলীয় পদে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছেন। তাঁদের মধ্যে রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া জিয়াউল হক মৃধা, মসিউর রহমান ও কাজী মামুনুর রশীদও রয়েছেন।


জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও দলের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা গত ৩০ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় আদালত দলীয় কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন থেকে জি এম কাদেরকে বিরত রাখতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। প্রায় তিন মাস তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত ছিলেন।


পরে উচ্চ আদালত নিষেধাজ্ঞার ওই আদেশ স্থগিত করলে তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তবে এখনো নানামুখী চাপের মধ্যে আছেন বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। এর মধ্যে রওশনপন্থীরা জাতীয় পার্টির প্যাড ও ঠিকানা ব্যবহার করে দলের নামে বিবৃতি-বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন সিদ্ধান্তও জানাচ্ছে।