ওজোপাডিকো দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বেপরোয়া

কালো টাকায় রতন-সেলিমের বিত্ত-বৈভবের সামাজ্য


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৫:০৯ অপরাহ্ন, ১০ই সেপ্টেম্বর ২০২৪


কালো টাকায় রতন-সেলিমের বিত্ত-বৈভবের সামাজ্য
ছবি: জনবাণী

ঘুষ আর তদবির ছাড়া থাকতে পারতেন না ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) রতন কুমার দেবনাথ। অনেকটা ঔষধের মেতা প্রতিদিন প্রতি বিলে ঘুষ না পেলে রেগে যান তিনি। তার দুর্নীতিতে অন্যতম সহযোগি বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ওজোপাডিকো ও বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির চেয়ারম্যান সেলিম আবেদ। পারসেনটেজ ছাড়া কোনো ঠিকাদার কাজ পেয়েছে এমন নজির নেই। অল্প সময়ে দুর্নীতির মাধ্যমে রতন কুমার দেবনাথ ও সেলিম আবেদ  যে পরিমান টাকা কামিয়েছেন, সেটি আলাদিনের চেরাগের মতো। আগের সরকারের সময়ে ঘুষ ছাড়া হুশ মেলে না এই দুই সরকারি কর্মকর্তার। চাকরিকে কিভাবে সোনার হরিন বানাতে হয় তা নিয়ে পিএইচডি করলে নি:সন্দেহে গবেষক হতেন এই দুই কর্মকর্তা। টাকার বিনিময়ে দরপত্র দেয়া, মিথ্যা অডিট রিপোর্ট, মামলা  দেয়াসহ তদবির বানিজ্যের মাধ্যমে কামিয়ছেন শত শত কোটি টাকা।  কানাডায় ও ভারতে বাড়ি-গাড়ি ও দেশে প্রচুর বিত্ত বৈভব তাদের। সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের অপকর্মের কোনো পরিবর্তন হয়নি। 


বেশ কয়েকটি সূত্রে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) এর নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) রতন কুমার দেবনাথ আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট এবং সেই সুবাদে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে তার ভালো সখ্যতা। প্রতি বিলে সে সব ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় অংকের ঘুষ নিতো এবং ঘুষবিহীন কোনো বিল প্রদান করতো না।


স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনায় সে ছিলো বরাবরই প্রভাবশালী এবং দূর্নীতিবাজদের প্রিয়মুখ। রতন কুমার দেবনাথ নির্বাহী পরিচালক অর্থ পদে যখন বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানীর সঙ্গে ওজোপাডিকোর প্রকল্পের বিল ছাড় করেন তখন বিলের ১% টাকা ঘুষ হিসেবে চান। ৫১% সরকারী মালিকানাধীন এই কোম্পানীর তাকে ঘুষ দেওয়ার কোনও সুযোগ ছিলো না। ঘুষ না পেয়ে ক্ষেপে যান রতন কুমার দেবনাথ এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। মূসক জমা দেওয়ার পরো অতিরিক্ত ভ্যাট কেটে রাখেন।   


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের একান্ত সচিব থাকার সুবাদে সেলিম আবেদ (পরিচিতি নং-৬০১২) প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদে যুগ্ন সচিব ও বিউবোর সদস্য, অর্থ হিসেবে পদস্থ হন।  পরবর্তীতে একই মন্ত্রনালয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হন। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ওজোপাডিকো ও বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির চেয়ারম্যান হন। স্বেচ্ছাচারী বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীর সাথে তার এতোটাই সখ্যতা ছিলো যে, প্রতিদিন দুপুরে সেলিম আবেদ প্রতিমন্ত্রীর সাথে মন্ত্রনালয়ে খাবার খেতেন এবং ব্যবসার তদবির ও কমিশনের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন।  সেলিম আবেদ নিজের অফিসে বসে ঠিকাদারদের সাথে মদ্যপান ও ধূমপান করতেন এবং তাদের সাথে কমিশনের দর কষাকষি করতেন। কোনো ঠিকাদার তার সাথে লেনদেনের সম্পর্ক ভালো করলে তার কথায় সে অন্য ঠিকাদারকে বসিয়ে দিতেন। 



সূত্রে জানা গেছে, সেলিম আবেদ সরকারী চাকরী করা সত্ত্বেও অনেকগুলো ঠিকাদারি কোম্পানির হয়ে দালালি ও টেন্ডারবাজি করেন। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব থাকা অবস্থা থেকেই আইডিয়াল ইলেকট্রিকাল কোম্পানি নামে একটি ট্রেডিং কোম্পানির ব্যবসায়িক পার্টনার বা দালাল হন।  প্রতি টেন্ডারে তার জন্য লাভের পারসেন্টেজ থাকতো।  ওজোপাডিকোর প্রায় সকল সাবস্টেশন ও প্রিপেইড মিটারের টেন্ডারের কাজ পেতো আইডিয়াল নামের এক কোম্পানি।  আগেই প্রাক্কলিত মূল্য আর দরপত্র দিয়ে দিতেন সেই প্রতিষ্ঠানকে। দরপত্র মূল্যায়নের সময় বাকি সব কোম্পানিকে নন-রেসপন্সিভ করে তাদের কাজ দিতেন এবং দেখাতেন যে তাদের দামও প্রাক্কলিত মূল্যের মধ্যে।  ওজোপাডিকো ছাড়াও অন্যান্য সংস্থায় সেলিম আবেদ এই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য তদবির করতেন হিসেবে।  বিনিময়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পকেটে ভরেন সেলিম আবেদ। এখনো এমনকি অবসরে যাওয়ার পরও সেই কোম্পানির জন্য তদবির করেন সেলিম আবেদ।  সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশে সেলিম আবেদ সোনাগাজী সোলার পাওয়ার কোম্পানীকে ৫০ মেগাওয়াট সোলার মেগা পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট পাইয়ে দেন। কানাডায় বাড়ি-গাড়ি ও দেশে প্রচুর বিত্ত বৈভব ও বিলাসবহুল জীবনযাত্রা আবেদের। 


বিভিন্ন সূত্রে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিনের অবসর গ্রহণ করার পর রতন কুমার দেবনাথ ওজোপাডিকো ও বাংলাদেশ স্মার্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথে সুযোগ বুঝে বাংলাদেশ স্মার্ট কোম্পানি লিমিটেডের বোর্ডে কয়েকটি বিল অডিট করার কথা বলে চক্রান্ত করে ওজোপাডিকো বোর্ডের বিনা অনুমতিতে শুধুমাত্র ওজোপাডিকোর তিনজনকে দিয়ে একটি একপাক্ষিক অডিটের নাটক সাজান। অডিট কমিটিতে ছিলো শুধুমাত্র ওজোপাডিকো থেকে ৩ জন কর্মকর্তা যার মধ্যে আহবায়ক এ এন এম মোস্তাফিজুর রহমান, মহাব্যবস্থাপক, হিসাব ও অর্থ; মোঃ আজিজুর রহমান, উপব্যবস্থাপক, অডিট, ওজোপাডিকো, সদস্য এবং মোঃ নজরুল ইসলাম, উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী, ওজোপাডিকো, সদস্য যা এই কোম্পানির যৌথ উদ্যোগ চুক্তির পরিপন্থি। সেলিম আবেদ তার ভাতিজা এ এন এম মোস্তাফিজুর রহমানকে বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির অর্থের দায়িত্ব দেন পরিচালক, অর্থ ও বোর্ড সদস্য হিসেবে।


 অভিযোগ রয়েছে, ব্যক্তিগত আক্রোষের বর্শবর্তী হয়ে সেই বেআইনী অডিট রিপোর্ট পুঁজি করে মিডিয়াতে এবং বিভিন্ন সংস্থায় অভিযোগ দিয়ে এবং সেলিম আবেদের সহযোগিতায় রতন তৎকালীন সময়ে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পদায়ন পাওয়া চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব জনাব নুরুল আলম ওজোপাডিকোতে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও সেলিম আবেদ জোরপূর্বক একটি বোর্ড মিটিং করেন এবং সেই বোর্ড মিটিংয়ে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য নিজেদের বিপক্ষের লোকদের (শফিক উদ্দিন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ওজোপাডিকো ও আব্দুল মোতালেব, কোম্পানি সচিব) এবং দুই কোম্পানীকে ফাঁসিয়ে একই বিষয়ে বিভিন্ন কোর্টে মামলা ও অভিযোগ করার অনুমোদন করেন। রতন কুমার দেবনাথ নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিজে অভিযোগ পাঠান দুদকে। এমনকি নিজে বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন।


রতন ১৫ লাখ টাকা ‘সম্মানীর’ বিনিময়ে দুই বছরের এসিআর নেন তৎকালীন ওজোপাডিকোর দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান সেলিম আবেদের কাছ থেকে। নির্বাহী পরিচালকের এসিআর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেওয়ার কথা থাকলেও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন তার কাজে অত্যন্ত অখুশি ছিলেন এবং এসিআর দেননি। শফিক উদ্দিনের অবসর গ্রহণ করার পর তার পেছনে লাগেন রতন। তার সংকল্প- যেকোনো মূল্যে শফিক উদ্দিনকে জেলের ভাত খাওয়াবেন। তিনি নিজেকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সাথে সম্পৃক্ত বলে দাবি করেন।  রতন কুমার দেবনাথ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ভারতে পাচার করেন এবং দেশে ও ভারতে প্রচুর অবৈধ সম্পত্তির মালিক হন।

   

সূত্র মতে, বেআইনী অডিট রিপোর্টের উপর ভর করে রতন কুমার দেবনাথের মিথ্যা মনগড়া অভিযোগ দিয়ে টাকা এবং ক্ষমতার জোরে দুদকে মামলা করান তরুণ কান্তি ঘোষ, সহকারী ব্যবস্থাপক, দুদক, খুলনা ও তৎকালীন খুলনা দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শদের মাধ্যমে। স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের প্রভাবে দুদক একটি মামলা করে ওজোপাডিকোর শফিক উদ্দিন, আব্দুল মোতালেব ও চীনের নাগরিক ইয়ে ওয়েনজুনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির ও হেক্সিং প্রতিষ্ঠান দুটিকে ফাঁসিয়ে। তরুণ কান্তি ঘোষ, রতন কুমার দেবনাথ, রবীন দত্ত এবং আরো কিছু এক সম্প্রদায়ের ব্যক্তি একজোট হন।  তারা নিজেদের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে জড়িত থাকার ছলে প্রভাব বিস্তার করেন। দুদক খুলনা কার্যালয়ের তরুণ কান্তি ঘোষ রতন কুমারের অভিযোগ প্রাথমিক তদন্ত করে।  তরুণ কান্তি ঘোষ যশোরে বদলি হয়ে গেলেও আবার তরুণ কান্তি ঘোষকে বদলি হয়ে আবার তদবির করে খুলনায় আনা হয় এই মামলা নম্বর ০৪/২৩ তদন্তের জন্য। পরবর্তীতে ওজোপাডিকো বোর্ডের সিদ্ধান্তে ওজোপাডিকো দুদকের অভিযোগ প্রত্যাহার হলেও স্থানীয় আওয়ামী শক্তির মদদপুষ্ট চক্রের প্রভাবে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আজও শেষ করে পারেননি তরুণ কান্তি ঘোষ। 



বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনার নেতা রাফি ইসলাম দুর্নীতিবাজ রতন ও সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্ব সহাকারে দেখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও ট্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বরাবর চিঠি দিয়েছের তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের এই দুর্নীতি এবং অনিয়মের খবর পৌছে গেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে।  বিষয়টি নিয়ে যে কোনো সময়ে তদন্তে নামতে পারে সংশ্লিষ্টরা। 


এতে বলা হয়, ‘ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া দেশে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা চলতে পারে না। দেশের ভাবমূর্তি ও ইন্ডাস্ট্রি রক্ষা করতে এই চক্রান্তকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্টদের ব্যপারে তদন্ত করে দ্রুত তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করতে হবে।’    

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় সরকারের কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে অসৎ উদ্দেশ্যে আরেক পক্ষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড চীনের কোম্পানি হেক্সিং এর সাথে যৌথ উদ্যোগ চুক্তির মাধ্যমে চীনা কোম্পানির বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি নতুন কোম্পানি-‘বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানি লিমিটেড’ গঠন করে যার ফ্যাক্টরী খুলনায় অবস্থিত।  এই নতুন কোম্পানী চলার পথে প্রতি পদে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে একদল আরেক দলকে ঘায়েল করতে গিয়ে গত তিন বছরে কোম্পানীটির এবং দেশের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।’ সরকারী মালিকানাধীন এই কোম্পানীর তাকে ঘুষ দেওয়ার কোনও সুযোগ ছিলো না এবং ঘুষ দেওয়া কোম্পানির কমপ্লায়েন্সের পরিপন্থি। কিন্তু ঘুষ না পেয়ে ক্ষেপে যান রতন কুমার দেবনাথ। 



খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের একান্ত সচিব থাকার সুবাদে সেলিম আবেদ (পরিচিতি নং-৬০১২) প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদে যুগ্ন সচিব ও বিউবোর সদস্য, অর্থ হিসেবে পদস্থ হন।  পরবর্তীতে একই মন্ত্রনালয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হন। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ওজোপাডিকো ও বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির চেয়ারম্যান হন। স্বেচ্ছাচারী বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীর সাথে তার এতোটাই সখ্যতা ছিলো যে, প্রতিদিন দুপুরে সেলিম আবেদ প্রতিমন্ত্রীর সাথে মন্ত্রনালয়ে খাবার খেতেন এবং ব্যবসার তদবির ও কমিশনের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন।  সেলিম আবেদ নিজের অফিসে বসে ঠিকাদারদের সাথে মদ্যপান ও ধূমপান করতেন এবং তাদের সাথে কমিশনের দর কষাকষি করতেন। কোনো ঠিকাদার তার সাথে লেনদেনের সম্পর্ক ভালো করলে তার কথায় সে অন্য ঠিকাদারকে বসিয়ে দিতেন। 


সূত্রে জানা গেছে, সেলিম আবেদ সরকারী চাকরী করা সত্ত্বেও আইডিয়াল ইলেকট্রিকাল কোম্পানি নামে একটি ট্রেডিং কোম্পানির ব্যবসায়িক পার্টনার বা দালাল হন।  প্রতি টেন্ডারে তার জন্য লাভের পারসেন্টেজ থাকতো।  ফলে ওজোপাডিকোর প্রায় সকল সাবস্টেশন ও প্রিপেইড মিটারের টেন্ডারের কাজ পেতো আইডিয়াল নামের এক কোম্পানি।  আগেই প্রাক্কলিত মূল্য আর দরপত্র দিয়ে দিতেন সেই প্রতিষ্ঠানকে। দরপত্র মূল্যায়নের সময় বাকি সব কোম্পানিকে নন-রেসপন্সিভ করে তাদের কাজ দিতেন এবং দেখাতেন যে তাদের দামও প্রাক্কলিত মূল্যের মধ্যে।  ওজোপাডিকো ছাড়াও অন্যান্য সংস্থায় সেলিম আবেদ এই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য তদবির করতেন হিসেবে। বিনিময়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পকেটে ভরেন সেলিম আবেদ।  এখনো এমনকি অবসরে যাওয়ার পরও সেই কোম্পানির জন্য তদবির করেন সেলিম আবেদ।  সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশে সেলিম আবেদ সোনাগাজী সোলার পাওয়ার কোম্পানীকে ৫০ মেগাওয়াট সোলার মেগা পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট পাইয়ে দেন।  কানাডায় বাড়ি-গাড়ি ও দেশে প্রচুর বিত্ত বৈভব আবেদের।



বিভিন্ন সূত্রে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, এদিকে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিনের অবসর গ্রহণ করার পর রতন কুমার দেবনাথ ওজোপাডিকো ও বাংলাদেশ স্মার্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথে সুযোগ বুঝে বাংলাদেশ স্মার্ট কোম্পানি লিমিটেডের বোর্ডে কয়েকটি বিল অডিট করার কথা বলে চক্রান্ত করে ওজোপাডিকো বোর্ডের বিনা অনুমতিতে শুধুমাত্র ওজোপাডিকোর তিনজনকে দিয়ে একটি একপাক্ষিক অডিটের নাটক সাজান। অডিট কমিটিতে ছিলো শুধুমাত্র ওজোপাডিকো থেকে ৩ জন কর্মকর্তা যার মধ্যে আহবায়ক এ এন এম মোস্তাফিজুর রহমান, মহাব্যবস্থাপক, হিসাব ও অর্থ; মোঃ আজিজুর রহমান, উপব্যবস্থাপক, অডিট, ওজোপাডিকো, সদস্য এবং মোঃ নজরুল ইসলাম, উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী, ওজোপাডিকো, সদস্য যা এই কোম্পানির যৌথ উদ্যোগ চুক্তির পরিপন্থি। সেলিম আবেদ তার ভাতিজা এ এন এম মোস্তাফিজুর রহমানকে বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির অর্থের দায়িত্ব দেন পরিচালক, অর্থ ও বোর্ড সদস্য হিসেবে।


 অভিযোগ রয়েছে, ব্যক্তিগত আক্রোষে সেই বেআইনী অডিট রিপোর্ট পুঁজি করে মিডিয়াতে এবং বিভিন্ন সংস্থায় অভিযোগ দিয়ে এবং সেলিম আবেদের সহযোগিতায় রতন তৎকালীন সময়ে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পদায়ন পাওয়া চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব জনাব নুরুল আলম ওজোপাডিকোতে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও সেলিম আবেদ জোরপূর্বক একটি বোর্ড মিটিং করেন এবং সেই বোর্ড মিটিংয়ে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য নিজেদের বিপক্ষের লোকদের (শফিক উদ্দিন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ওজোপাডিকো ও আব্দুল মোতালেব) এবং দুই কোম্পানীকে ফাঁসিয়ে একই বিষয়ে বিভিন্ন কোর্টে মামলা ও অভিযোগ করার অনুমোদন করেন। রতন কুমার দেবনাথ নিজের প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিজে অভিযোগ পাঠান দুদকে। রতন ১৫ লাখ টাকা ‘সম্মানীর’ বিনিময়ে দুই বছরের এসিআর নেন তৎকালীন দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যান সেলিম আবেদের কাছ থেকে। নির্বাহী পরিচালকের এসিআর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেওয়ার কথা থাকলেও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন তার কাজে অত্যন্ত অখুশি ছিলেন এবং এসিআর দেননি।  শফিক উদ্দিনের অবসর গ্রহণ করার পর তার পেছনে লাগেন রতন। তার সংকল্প- যেকোনো মূল্যে শফিক উদ্দিনকে জেলের ভাত খাওয়াবেন।  তিনি নিজেকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সাথে সম্পৃক্ত বলেও দাবি করেন। রতন কুমার দেবনাথ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ভারতে পাচার করেন এবং দেশে ও ভারতে প্রচুর অবৈধ সম্পত্তির মালিক হন।

  

সূত্র মতে, বেআইনী অডিট রিপোর্টের উপর ভর করে রতন কুমার দেবনাথের মিথ্যা মনগড়া অভিযোগ দিয়ে টাকা এবং ক্ষমতার জোরে দুদকে মামলা করান তরুণ কান্তি ঘোষ, সহকারী ব্যবস্থাপক, দুদক, খুলনা ও তৎকালীন খুলনা দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শদের মাধ্যমে। স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের প্রভাবে দুদক একটি মামলা করে ওজোপাডিকোর শফিক উদ্দিন, আব্দুল মোতালেব ও চীনের নাগরিক ইয়ে ওয়েনজুনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির ও হেক্সি প্রতিষ্ঠান দুটিকে ফাঁসিয়ে। তরুণ কান্তি ঘোষ, রতন কুমার দেবনাথ, রবীন দত্ত এবং আরো কিছু এক সম্প্রদায়ের ব্যক্তি একজোট হন। দুদক খুলনা কার্যালয়ের তরুণ কান্তি ঘোষ রতন কুমারের অভিযোগ প্রাথমিক তদন্ত করে। তরুণ কান্তি ঘোষ যশোরে বদলি হয়ে গেলেও আবার তরুণ কান্তি ঘোষকে বদলি হয়ে আবার তদবির করে খুলনায় আনা হয় এই মামলা নম্বর ০৪/২৩ তদন্তের জন্য। পরবর্তীতে ওজোপাডিকো বোর্ডের সিদ্ধান্তে ওজোপাডিকো দুদকের অভিযোগ প্রত্যাহার হলেও স্থানীয় আওয়ামী শক্তির মদদপুষ্ট চক্রের প্রভাবে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আজও শেষ করে পারেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা তরুণ কান্তি।          


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনার নেতা রাফি ইসলাম দুর্নীতিবাজ রতন ও সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্ব সহাকারে দেখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও ট্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বরাবর চিঠি দিয়েছের তিনি।



ছাত্রদের দাবী, ‘ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া দেশে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা চলতে পারে না। দেশের ভাবমূর্তি ও ইন্ডাস্ট্রি রক্ষা করতে এই চক্রান্তকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্টদের ব্যপারে তদন্ত করে দ্রুত তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করতে হবে।


জানা যায় বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় সরকারের কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে অসৎ উদ্দেশ্যে আরেক পক্ষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড চীনের কোম্পানি হেক্সিং এর সাথে যৌথ উদ্যোগ চুক্তির মাধ্যমে চীনা কোম্পানির বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুত ও সংযোজনকারী একটি নতুন কোম্পানি-‘বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানি লিমিটেড’ গঠন করে যার ফ্যাক্টরী খুলনায় অবস্থিত। এই নতুন কোম্পানী চলার পথে প্রতি পদে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে একদল আরেক দলকে ঘায়েল করতে গিয়ে গত তিন বছরে কোম্পানীটির এবং দেশের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।


এ ব্যাপারে ওজোপাডিকো এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) রতন কুমার দেবনাথ এর মুঠো ফোন কল দিলে তিনি রিসিপ করেননি। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ওজোপাডিকো ও বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিকাল কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আবেদ মুঠো ফোন রিসিপ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তার পাওয়া যায়নি। খুলনা দুদকের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তরুণ কান্তি ঘোষ ফোন রিসিপ করেননি। 


জেবি/এসবি