দুর্নীতি জালিয়াতির মাস্টার সুন্দরবন গ্যাসের হাফিজুর


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ১২:০০ অপরাহ্ন, ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২৪


দুর্নীতি জালিয়াতির মাস্টার সুন্দরবন গ্যাসের হাফিজুর
ছবি: জনবাণী

অফিসের নথি গায়েব, ফেক আইডি দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সহকর্মীদের নামে অপপ্রচার, দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাট থেকে হেন অপকর্ম নেই করেন নি। একাধিক তদন্ত কমিটি তাকে দোষি সাব্যস্ত করেছে, খোদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক যাকে বদলীর অনুরোধ করেছেন, তারপরও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন সেই কর্মকর্তা। দুর্নীতির জালিয়াতির মাস্টার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (এসজিসিএল) উপ-ব্যবস্থাপক (সার্ভিস) হাফিজুর রহমান। তার কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ ছিলেন কমবেশি সব শীর্ষ কর্তারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতার জোরে যা খুশি তাই করে চলেছেন। যারাই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তাদের করুণ পরিণতি হয়েছে। ২০১৮ সালে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশতাক আহমেদ কলম ধরেছিলেন তার বিরুদ্ধে। হাফিজুর রহমানকে অন্যত্র বদলী করার পেট্রোবাংলার পরিচালক প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছিলেন। তবুও হাফিজুর রহমানকে সরানো যায়নি। উল্টো ৭ মাসের মাথায় মুশতাক আহমদকেই খেয়ে দেন হাফিজুর রহমান। এভাবে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন হাফিজুর রহমান। পেট্রোবাংলায় প্রেরিত চিঠিতে (সুত্র নংঃ ২৮.২১.০০০০.১১৮.১৯.০৬১.১৬/৭০৬) মুশতাক আহমদ লেখেন,..কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত এবং পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোম্পানির একজন কর্মকর্তার এ ধরণের কার্যক্রম প্রশাসনিক নিয়মের পরিপন্থী। যা কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যহত করছে। কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রম বজার রাখার স্বার্থে তাকে (হাফিজুর রহমান) অন্যত্র বদলির ব্যবস্থার জন্য অনুরোধ করা হলো। মুশতাক আহমদ এর সেই চিঠি দেওয়ার পর প্রায় ৬ বছর গত হতে চলেছে, কিন্তু হাফিজুর রহমান রয়েই গেছেন।


হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠে অফিসের নথি গায়েব করে ভুয়া নথি তৈরি করার। তাও আবার খোদ কোম্পানির গোপনীয় প্রতিবেদনের নথি। ২০১৮ সালে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে ক্যাডার ভিত্তিক উপযুক্ত কর্মকর্তাদের নবম গ্রেড হতে ষষ্ঠ গ্রেডে বেতনস্কেলে পদোন্নতির বিষয়ে এইচআর বিভাগে রক্ষিত পদোন্নতির নথিতে গড়মিল পাওয়া যায়। মুল নোটের কপি না পাওয়া এবং অন্যত্র ২টি ভিন্ন রকমের অনুমোদিত নোটের ফটোকপি রাখা তদন্তে নামে এসজিসিএল।


নথি জালিয়াতির ওই ঘটনায় ২০২১ সালের ২২ মার্চ প্রকৌশলী তৌহিদুর রহমান (মহাব্যবস্থাপক অপরেশন) প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে রিপোর্ট প্রদান করেন। রিপোর্টে পদোন্নতির মূল নথিতে দাপ্তরিক কাগজপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণ না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ দেয় (জুন ২৮, ২০২১)।


তৌহিদুর রহমান কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং অধিকতর তদন্তের জন্য মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) নাজমুল হাসানকে প্রধান করে ৪ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নাজমুল হাসান কমিটি বিশাল রিপোর্ট প্রদান করে। এতে বলা হয়েছে, তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক (এইচআর) মোঃ সালাউদ্দিন, ব্যবস্থাপক (পার্সোনাল) মোঃ জিল্লুর রহমানের লিখিত বক্তব্য অনুযায়ী পদোন্নতির মুল নথিতে দাপ্তরিক কাগজপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা ৩০ ও ৩১ নম্বর নোটাংশের মধ্যে দ্বিতীয় অনুমোদিত নোটাংশের ই-মেইল কপি পরিবর্তন/সরিয়ে ফেলে স্বউদ্যোগে নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে বাতিলকৃত নোটাংশটি সন্তপর্ণে স্থাপন করায় হাফিজুরকে কোম্পানির চাকুরি প্রবিধানমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হচ্ছে।


রিপোর্টে বলা হয়, উপব্যবস্থাপক মোঃ হাফিজুর রহমানের মত অসৎ কর্তব্যে অবহেলাকারী ঔদ্ধত্যপূর্ণ, কোম্পানির স্বার্থ হানিকর কাজের সাথে জড়িত কর্মকর্তাকে প্রশাসন বিভাগ এবং কোম্পানির সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপুর্ণ স্থানে ভবিষ্যতে পদায়ন না করার জন্য কমিটি সুপারিশ করছে।


সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অফিসিয়াল মেসেঞ্জার গ্রুপে উস্কানি ও মানহানিকর তথ্য ছড়ানোর দায়েও অভিযুক্ত হন হাফিজুর রহমান। এ বিষয়েও তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। সেই শোকজের জবাবে (২০২১ সালের ১ আগস্ট) সরল বিশ্বাসে মন্তব্য করেছেন বলে স্বীকার করে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। পরে তাকে উপদেশ পত্র প্রদান করে এসজিসিএল এর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল হাসান।

উপদেশ পত্রে বলা হয়, সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় আপনার জবাব কর্তৃপক্ষের নিকট আশানূরূপ না হওয়ায় কোম্পানিতে আপনার স্বল্প চাকরিকাল, পদমর্যাদা, মেধা ও আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ আপনার প্রতি বিরূপ আচরণ/সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে ফেসবুক মেসেজ্ঞার গ্রুপে মন্তব্য করার বিষয়ে ভবিষ্যতে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার জন্য আপনাকে উপদেশ প্রদান করা হলো। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের জন্য এহেন বিব্রতকর কর্যক্রম পরিলক্ষিত হলে আপনার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


তারপরও কি হাফিজুর রহমান সংশোধন হয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে এসজিসিএল এর একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব সময় দুর্নীতি অনিয়ম করে পার পেয়ে যাওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন, কাউকেই পরোয়া করেন না। বাজেট না থাকলেও অফিস সজ্জায় ৫ কোটি টাকা খরচ করেছেন। পরে সেই বিল প্রতিদিন ৫ লাখ টাকা করে তুলে নিয়েছেন। জনশ্রুতি রয়েছে অন্যের লাইসেন্স দেখানো হলেও টেন্ডার ছাড়া কাজটি তিনি নিজে করেছেন। এভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন, সাতক্ষীরা কালীগঞ্জের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান। খোদ খুলনা শহরে কয়েক কোটি টাকার জমি কিনেছেন। খালিশপুরে ১০ কাঠা জমি কিনেছে যার বাজারমুল্য প্রায় ২ কোটি টাকার উপরে। কিনেছেন বয়রা ও জেলখানা এলাকায় জমি। সেগুলোর মূল্যও কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া নিজ এলাকা ও খুলনা শহরে রয়েছে তার নামে বেনামে অনেক সম্পদ।  

আওয়ামী লীগের এক নেতার হাত ধরে চাকরি পান হাফিজুর রহমান। আর সেই নেতার জোরেই রামরাজত্ব চালিয়ে গেছেন। এখন চলছে সগৌরবে। ২০১৬ সাল থেকে অফিসার্স এসোসিয়েশন দখল করে রেখেছেন। ভোটের দাবি উঠলেও তাদেরকে হুমকি ধামকি দিয়ে দমিয়ে দিয়েছেন।



হাফিজুর রহমান বলেন, এখানে নথি গায়েবের কোন ঘটনা নেই, মনগড়া অভিযোগ দিয়ে, আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। অন্য বিষয় ছিল, একটা নথিতে নোটের বিষয়ে। 


দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ গড়া প্রসঙ্গে বলেন, খালিশপুরে হাউজ লোন নিয়ে ৪জন মিলে ৭০ লাখ টাকা দিয়ে সাড়ে ৭ কাঠার প্লট কিনেছি। ২০১৯ সালে ৮ শতক জমি কিনেছি সেটাও লোন নিয়ে। এই ঘটনায় এর আগেও দুদক ও পেট্রোবাংলা তদন্ত করেছে। আমি নির্দোশ প্রমানিত হয়েছি। কোনো প্রকার দুর্নীতি আমি করেনি। দুর্নীতি কিভাবে করে তা আমি বুঝি না। 


অফিসার্স এসোসিয়েশন দখল করে রাখা প্রসঙ্গে বলেন, এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন ২০১৯ সালে সিলেকশনের মাধ্যমে কমিটি হয়েছে। চলতি সপ্তাহে নির্বাচনের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে।


এ বিষয় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, অতীতের বিষয়গুলো আমার নজরে আনা হয় নি। সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলো খোঁজ নিয়ে দেখবো। কোন দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


২০১৮ সালে খোদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকে বদলীর অনুরোধ করেন। অধিনস্থ কোম্পানির পক্ষ থেকে এমন অনুরোধ পেলে পেট্রোবাংলার কি নীতি অনুসরণ করে। এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বদলীতো কোন শাস্তি না, অনিয়মের প্রমান পাওয়া গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কেনো হলো না বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবো।

এ বিষয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি’র)নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবে বাড়ছে দুর্নীতি। দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তাদের আইনের আওতায় আনলেই কমবে দুর্নীতি।


জেবি/এসবি