ঘুষের টাকায় অপুর অঢেল সম্পদ


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০১:১০ অপরাহ্ন, ৮ই অক্টোবর ২০২৪


ঘুষের টাকায় অপুর অঢেল সম্পদ
ছবি: জনবাণী

সাবেক তথ্য কর্মকর্তা শরীফ মাহামুদ অপু’র অর্থ, প্রভাব ও প্রতিপত্তি রূপকথার গল্পের মতো। দলীয় রাজনীতি তার কাছে ছিল ধরাশায়ী। আইন-আদালত তার কাছে ঠুঁটো জগন্নাথ। প্রশাসনের বড় কর্মকর্তারা তাঁর কাছে ছিলেন ছাপোষা। তার রুমে ঠাই হতো না সংবাদকর্মীদের।  সচিবালয়ে ঘিরে ছিলো নিজস্ব বলয়। তিনি ছিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের মুকট বিহীন সম্রাট। তার অফিস কক্ষে টাকা যেন বাতাসে উড়ত। তিনি যা চাইতেন তাই করতেন। ঘটনাটি বেশিদিন আগের নয়। শাহবাগে কোটা আন্দোলন শুরুর মাসখানেক আগের কথা। দু’তিনজন দর্শনার্থী বসে ছিলেন সচিবালয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কক্ষে। এ সময় একজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রীর কক্ষে এলেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা (পিআরও) শরীফ মাহামুদ অপু। কথা থামিয়ে মন্ত্রী কাগজটা হাতে নিলেন। দেখলেন, তাকালেন পিআরও’র দিকে। পিআরও মাথা নাড়িয়ে বললেন পেয়েছি। মন্ত্রী কলমদানি থেকে কলম নিয়ে একটি ইনিসিয়াল দিয়ে কাগজটি পিআরওর সঙ্গে আসা উপসচিবের হাতে দিলেন। বেরিয়ে গেলেন দু’জনেই। মন্ত্রী আবার দৃষ্টি ফেরালেন টেবিলের সামনে বসা তার নির্বাচনী এলাকা থেকে তদবিরে আসা লোকদের দিকে। পিআরও’র হাতে থাকা সেই কাগজটি আসলে কিসের, যা স্বাক্ষর করার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সম্মতি জানিয়ে পিআরও বললেন পেয়েছি! বিষয়টি আসলে কী, তা জানতে উৎসাহ জাগল। উপসচিবের পিছু নিল দু’জন গণমাধ্যমকর্মী। জানতে চেয়ে উত্তর পাওয়া গেল না। এতে করে আরও জানার ইচ্ছা বাড়ল। ততক্ষণে উপসচিব তার কক্ষে ঢুকে কম্পোজ করতে দিল মন্ত্রীর ইনিসিয়াল (স্বাক্ষর) দেওয়া সেই চিঠিটি। কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা পিআরও শরীফ মাহামুদ অপুর জন্য। অপু বের হলেন চিঠিটি নিয়ে। জানতে চাইলেন গণমাধ্যম কর্মীরা... ‘সচিবের বদলির অর্ডার?’ অপু না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘সচিব স্যার না, এসপি বদলি।’ আবারও প্রশ্ন ‘ক’জন?’। অপু বললেন, ‘ছোট অর্ডার, তিনজন এসপি পদায়ন ও বদলি।’ দেখালেন প্রজ্ঞাপনটি। প্রথমটি বোঝা গেল... কুমিল্লার এসপিকে সিলেট জেলায় এসপি হিসেবে পদায়ন। তবে সিলেট জেলার এসপিকে কোথায় বা অন্য সৌভাগ্যবান দুজন এসপি কে... তা আর পড়া গেল না। কাগজটা এক ঝলক দেখিয়ে সরিয়ে নিলেন অত্যন্ত চতুর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর এই পিআরও।



বিস্তারিত জানতে এক দিন অপেক্ষার পর জানা গেল, তিনজন এসপি নতুন জেলায় বদলি করার আদেশটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মতি নিতে এসেছিলেন সেই উপসচিব এবং পিআরও।



ওইদিন প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয়নি। পরের দিন প্রজ্ঞাপনটি দেখেই গণমাধ্যমকর্মীদের জানার অবসান ঘটল। তবে পিআরও’র ‘পেয়েছি’ বলার বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমে কুমিল্লার বদলি হওয়া এসপি আব্দুল মান্নানের ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকেই জানা গেল কী পেয়েছিলেন পিআরও? জানা গেল ভয়াবহ তথ্য। এসপি বদলিতে ১ বছরের জন্য ১ কোটি টাকা। স্থান ভেদে ২ থেকে ৩ কোটি টাকাও দিতে হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘স্যার’ না বলে ‘বাবা’ ডাকা শরীফ মাহামুদ অপুকে। ঘুষের এই টাকার একটি অংশ নিজে রেখে বাকিটা রাতে ধানমন্ডির বাসায় মন্ত্রীর ছেলের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হতো। এভাবেই আসাদুজ্জামান খান কামাল, তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও পুত্রের কাছে বিশ^স্ত হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ বেতারের ২৮ ব্যাচের (অনুষ্ঠান) এই কর্মকর্তা। জানা যায়, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পূর্ণমতি গ্রামের জয়নাল আবেদিনের সন্তান শরীফ মাহমুদ অপু বেতারের চাকরিতে যোগদানের পরেও টানাটানির মধ্য দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছিলেন জীবন। তবে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে পুরোপুরি বদলে ফেলেন নিজেকে। এরপর আর পিছু ফিরতে হয়নি তাকে। দারিদ্র্যতাও আর স্পর্শ করতে পারেনি। 



পূর্ণমতি গ্রামের সাজ্জাদ খান বলেন, এই অপু বাড়িতে এলে পুলিশ তাকে প্রটেকশন দিতো। এগুলো দেখে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। তার ক্ষমতার প্রভাব এতটাই ছিল যে, কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি তার বাবা জয়নাল আবেদিনকে বুড়িচং সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন এবং পূর্ণমতি এম এ উচ্চ বিদ্যালয় কমিটির সভাপতিসহ নানা পদপদবির দায়িত্বে বসিয়েছিলেন। এই স্কুলের ভেতরে তার একটি প্রাইভেট রুম ছিল। স্কুলের অভিভাবক জালাল বলেন, এই জয়নাল এখানে অসামাজিক কার্যকলাপ করতেন। তার ছেলের ক্ষমতার ভয়ে কেউ কিছু বলত না।


শরীফ মাহামুদ অপু তেজগাঁও-হাতিরঝিল থেকে নির্বাচিত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রায় দশ বছরের তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। অবৈধ আয়ের অর্থে বাড়ি, গাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট এমনকি ব্যাংককের পাতায়া রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন। রাজধানীর বসুন্ধরা, উত্তরা ও গুলশানে বেশ কয়েকটি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছেন অপু। নিজের ও স্ত্রীর ব্যাংক হিসেবে রয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা। 


অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পুলিশের এসপি, ওসি ও এসআই বদলির পাশাপাশি তিনি অন্তত অর্ধশত ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছেন। যার বিনিময়ে অপু নিজের এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের জন্য নিয়েছেন ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা। এসব টাকার বড় একটি অংশ দিতে হতো কামালের ছেলে অথবা তার স্ত্রীর কাছে।


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পালিয়ে যাওয়ার পরও জোর করে অর্থ কামাইয়ের এই মন্ত্রণালয়ে থাকতে চেয়েছিলেন শরীফ মাহামুদ অপু। নতুন পিআরও নিয়োগের পরও তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়ার পাশাপাশি নির্ধারিত কক্ষেও প্রবেশে বাধা দিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কক্ষটি ছেড়ে বিদায় নেন। বর্তমানে তিনি বেতারে ফিরেছেন।


এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সিপাহ সালার শরীফ মাহামুদ অপুর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দাখিলের পর তাকে ডাকা হয়েছিল। দুদকে হাজিরাও দিয়েছেন তিনি। তার অর্থ সম্পদের হিসাবও জমা দিয়েছেন অপু। তবে এসবের তথ্য নিয়ে শিগগিরই অনুসন্ধানে নামবে সংস্থাটি।



দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আয়ের উৎস তদন্তে নামছে দুদক। এতেও নাম এসেছে শরীফ মাহামুদ অপুর।



এ ব্যাপারে শরীফ মাহমুদ অপু বলেন, আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। মন্ত্রী যা বলতেন তাই করতাম। তার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই।  


জেবি/এসবি