চার প্রকৌশলীর কব্জায় ডিপিডিসি
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১২:০৪ অপরাহ্ন, ২০শে অক্টোবর ২০২৪

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের মিটারিং বিভাগ ছাড়া ‘কাজে মন বসে না’ এই বিভাগের দক্ষিণের দায়িত্বে থাকা সাব-ডিভিশনাল প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরীর (আইডি ২১৫৮৩)। চাকরিজীবনের ৯ বছরের মধ্যে ৮ বছরই তিনি কাজ করছেন এখানে। ডিপিডিসি সূত্র জানিয়েছে, মূলত, মিটারিং বিভাগে বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী গ্রাহক হয়রানি, দুর্নীতির মাধ্যমে থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও কালো টাকার মালিক হয়েছেন। এই ‘মধুর লোভে’ বদলির শঙ্কা দেখা দিলেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিুপ।
মিটারিং ডিভিশনের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মূলত ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুনিম ইসলাম, সাব-ডিভিশনাল (এসডি) প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী, সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আলামিন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেনসহ আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছেন মিটারিং ডিভিশনের সিন্ডিকেট। বছরের পর বছর একই জায়গায় পদায়ন থেকে গড়ে তুলেছেন রাজধানী জুড়ে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে গ্রাহক হয়রানি চরমে পৌঁছেছে। গ্রাহকের আঙ্গিনায় উচ্চচাপ মিটার সংযোগ চালু করতে গিয়ে গ্রাহকের কেনা ক্যাবল একটু নয় ছয় থাকলেই তারা চেপে ধরে গ্রাহককে টাকা নেয়ার জন্য। না হলে সংযোগ চালু করে না। গ্রাহকের নিকট থেকে তারা টাকা আদায় করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। উচ্চচাপ গ্রাহকদের মিটার সংযোগ করতে গিয়ে উৎকোচ না পেলেই এই চক্র নানান ফন্দি ফিকির করে সংযোগ আটকিয়ে দেয়। অসহায় গ্রাহক তখন বাধ্য হয়েই তাদের উৎকোচ দেয়।
অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে ডিপিডিসির মিটারিং বিভাগে অনিয়মকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গড়ে তুলেছেন একচ্ছত্র আধিপত্য। পলাশ কৃষ্ণের তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিপিডিসির সাউথ বেল্টের দায়িত্বে তিনি। মূলত ডিপিডিসির সবচেয়ে লোভনীয় জায়গা হলো নারায়ণগঞ্জ। কেনো না এই এলাকার বেশিরভাগ গ্রাহকই শিল্প প্রতিষ্ঠান। তার অধীনে থাকা উপ-সহকারী প্রকৌশলী সিব্বির ও আবুল হোসেন এর মাধ্যমে সে যত অনিয়ম করে অবৈধ পথে অর্থ কামাচ্ছে। সূত্র আরও জানায়, নারায়ণগঞ্জ বেল্টের স্থানীয় দালাল কবির, মালেক, মিজান ও বাহার রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই পলাশ কৃষ্ণ টাকা কামাচ্ছে। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ বেল্টের বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই সিন্ডিকেটের অন্যায় আবদারে তারা অতিষ্ঠ। তারা আরও অভিযোগ করেন, এদের বিষয়ে ডিপিডিসির প্রধান কার্যালয়ের লিখিত অভিযোগ দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে প্রকৌশলী পলাশ কৃষ্ণ চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, আমি কোন দুর্নীতি করি না। আমার নাম ব্যবহার করে আমার অধীনে থাকা প্রকৌশলীরা যদি মাঠ পর্যায়ে কোন দুর্নীতি করে সেটার দায় তো আমার না। মিটারিং ডিভিশনের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মিটারিং চক্রের আরেক সদস্য সহকারী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন দুর্নীতি করে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতি প্রসঙ্গে মুঠোফোনে তাকে প্রশ্ন করা হলে জানান, দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে আমি চাকুরী থেকে ইস্তেফা দিবো। আমার বিরুদ্ধে একটি মহল অপপ্রচার করছে। মিটাররিং ডিভিশনের সাব এ্যাসিস্টেন্ট প্রকৌশলী মোঃ আলামিন (আইডি- ২১৫২৫) এর চাকুরীর শুরুটা হয়েছিলো ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট। চাকুরীতে যোগদান করেই ট্রেনিং শেষে প্রথম পদায়ন পান মিটারিং ডিভিশনে। এরপর তার পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। একই জায়গায় ৯ বছর পদায়ন থেকে অনিয়ম আর দুর্নীতি করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
বলছিলাম আলামিনের কথা। মিটারিং ডিভিশনের পদায়ন পেয়ে তার হাতে এসেছে যেন আলাদিনের চেরাগ! একই জায়গায় প্রায় ৯ বছর চাকুরী করে গড়ে তুলেছে দুর্নীতির সিন্ডিকেট। আলামিন ডিপিডিসির সেন্ট্রালের আওতাধীন বনশ্রী, বাসাবো, নারিন্দা, মতিঝিল, মুগদা ও স্বামীবাগ এলাকায় উচ্চচাপ সংযোগকারীদের সংযোগ চালু করেন। আর এই সংযোগ চালু করার সূত্র ধরেই ছয়টি ডিভিশনে আলামিন আবার গড়ে তুলেছে একটি সিন্ডিকেট। সূত্র জানায়, কবির, শাহাদাত, করিম, মিলন, রাজ্জাক, হেলাল, মাসুদ করিম, শাহজাহান, ফয়েজসহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে আলামিনের স্থানীয় দালাল চক্র। গ্রাহকদের উচ্চচাপ সংযোগ আলামিন চালু করতে গেলেই টাকা উঠাতে এই দালাল চক্রই সহায়তা করে। জানা যায়, এই কর্মকর্তা উচ্চচাপ সংযোগ চালু করতে গেলে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা নেয়। আর এই টাকা না দিলে গ্রাহককে নানান ভোগান্তীতে ফেলে সে। সূত্র জানায়, আলামিন নামে ও বেনামে রাজধানীতে কিনেছে একাধিক ফ্ল্যাট।
গত দুই বছরের ডিপিডিসির মিটারিং ডিভিশনের উচ্চচাপ সংযোগের নথি ঘেটে দেখা যায়, আকরাম হোসেন, আব্দুর রশিদ, সিদ্দিকুর রহমান, ফয়েজ করিম, সিরাজুল ইসলাম, মাহামুদ বিশ্বাস, রায়হান, ইকবাল, শাকিল, তাহের মিয়াসহ উচ্চচাপ সংযোগগুলো চালু করতে গিয়ে এই আলামিন চক্র গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বড় অঙ্কের টাকা। এদের মধ্যে বনশ্রী ও মতিঝিলের দুই গ্রাহকের কাছ থেকে মিটার খারাপ বলে নয় ছয় করে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে মিটাররিং ডিভিশনের সাব এ্যাসিস্টেন্ট প্রকৌশলী মোঃ আলামিন জানান, এখানে চাকুরী করে অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। দুর্নীতি করাতো প্রশ্নই আসে না। তিনি আরও দাবী করেন যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই আমি এখানে রয়েছি। আপনার কোন কথা থাকলে বড় স্যারদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
মিটারিং ডিভিশনের মাফিয়া চক্রের আরেক সদস্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন (আইডি- ২১৯৮১)। চাকুরীর শুরুটা হয়েছিলো ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। চাকুরীতে যোগদান করেই তিনি এক মাসের মধ্যে বদলি নেন মিটারিং ডিভিশনে। নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ। এর তার পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আর। বদলি হয়েই তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মূলত আরিফ ডিপিডিসির সেন্ট্রালের এইচটি সংযোগ গুলো দেখেন। তারও রয়েছে স্থানীয় নেটওয়ার্ক চক্র। স্থানীয় পর্যায়ে তার চক্রের সদস্যরা হলেন- বাহার ও মিলন। সংযোগ করতে গিয়ে টাকা না পেলে গ্রাহকের সাথে অসাধাচারন তার এটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। তার বিরুদ্ধেও ডিপিডিসিতে রয়েছে অভিযোগ। কিন্তু কোন অভিযোগই সংস্থাটির কর্মকর্তারা আমলে নেয়নি। প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, মিটারিংয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির খতিয়ান এবং বেশ কয়েকবার গ্রাহকদের লিখিত অভিযোগের পরও রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ডিপিডিসি। তার কারন একটাই এই চক্রের কাছেও কর্তাব্যক্তিরা ম্যানেজ! অভিযোগ সম্পর্কে মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্য চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সারা দেননি।
তবে সংস্থাটির একাধিক সূত্র বলেছেন, সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) গোলাম মোস্তফার ছত্রছায়ায় দিনের পর দিন মিটারিংয়ে দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি সংগঠিত হয়েছিলো। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার এটিও একটি কারন ছিলো। মিটারিং ডিভিশনের সিন্ডিকেট চক্রটি এতটাই শক্তিশালী যে, কর্তৃপক্ষকেও তারা ম্যানেজ করে রেখেছে। কোন অভিযোগ হলেও ঐ অভিযোগ পত্রটিও গায়েব হয়ে যায়।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কোন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে রয়েছে। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের দোহাই দিয়ে ডিপিডিসিতে অভিযুক্তদের পদায়ন বন্ধ রেখেছে এ অভিযোগ সঠিক নয়। অভিযুক্তদের দোষ প্রমাণিত হলে দায়িদের বিরুদ্ধে অবশ্যই চাকুরীর বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
জেবি/এসবি