নওগাঁয় যেভাবে এল নাক ফজলি আম
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩:১২ অপরাহ্ন, ১৭ই মে ২০২৫

ফলের রাজা আম। অতুলনীয় স্বাদ আর পুষ্টিগুণে ভরা আম সবার কাছে প্রিয় ফল। ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি, ক্ষীরশাপাত, বারি-৪ সহ গুটি জাতের আমের জন্য বাংলাদেশের বিখ্যাত জেলা হচ্ছে নওগাঁ। সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) স্বীকৃতি পেয়েছে এ জেলার বদলগাছী উপজেলার নাক ফজলি আম। কিন্তু নাক ফজলি আম নওগাঁর বদলগাছীতে কীভাবে এল, প্রথম চারা কে নিয়ে আসেন, এটা আজও সবার অজানা।
আরও পড়ুন: নওগাঁয় ট্রেনে কাটা পড়ে বাবা-মেয়ের মৃত্যু
নাক ফজলি আম নিয়ে জেলায় আছে নানা কাহিনি। কথিত আছে, নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ভান্ডারপুরের জমিদার বিনোদ কুমার লাহিড়ীর হাত ধরে নাক ফজলি নামে পরিচিতি পায় আমটি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও আমচাষিদের কাছ থেকে জানা যায়, এই আমের আসল নাম হচ্ছে ‘নাক ফজলি’। গঙ্গাতীরবর্তী কাশী বা বেনারস ভারতের প্রধান আম উৎপাদন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিনোদ কুমার লাহিড়ীর মাধ্যমে বদলগাছী উপজেলায় প্রথম বিস্তার লাভ করে নাক ফজলি আম। অনেকে মনে করেন, এ আমের নিচের দিকে নাকের মতো চ্যাপ্টা হওয়ায় এর নামকরণ হয়েছে নাক ফজলি। জোড় কলমের মাধ্যমে এ আমের চারা রোপণ করার ১ থেকে ২ বছরের মধ্যে গাছে মুকুল আসে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন ইংরেজ শাসক লর্ড লিটন ছিলেন বাংলার গভর্নর (১৯২২-১৯২৭) এবং স্বল্প সময়ের জন্য ভারতের অস্থায়ী ভাইসরয়। তার আমলে এ অঞ্চলে জমিদারি প্রথা চালু ছিল। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ভান্ডারপুরে বিনোদ কুমার লাহিড়ী পরিবারের জমিদারি অঞ্চল ছিল। প্রতিবছর জমিদার বিনোদ কুমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তীর্থে যেতেন ভারতে। ফেরার পথে সঙ্গে নানা ধরনের ফলজ গাছের চারা নিয়ে আসতেন। যেমন কাশি ফজলি, বোম্বে ফজলি, দেবীভোগ, মালদা ফজলি ও নাক ফজলি। যে এলাকা থেকে চারা নিয়ে আসতেন, সেই এলাকার নাম দিয়ে নামকরণ করতেন তিনি।
এরপর থেকেই নাক ফজলি আম কলমের চারার মাধ্যমে আশপাশের গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে যেতে থাকে। এভাবেই আমটি পরিচিতি পায় ভান্ডারপুর গ্রামের বাইরে। নওগাঁর দুবলহাটি ও বলিহার রাজবাড়ির বাগানেও এ আমের গাছ ছিল বলে জানা যায়।
নওগাঁর বদলগাছী, ধামইরহাট, নওগাঁ সদর, রানীনগর ও মহাদেবপুর উপজেলায় নাক ফজলি আমের চাষ হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বদলগাছী থানার বদলগাছী, অধাইপুর, মথুরাপুর, কোলা, ভান্ডারপুর, দ্বীপগঞ্জ ও বৈকুন্ঠপুর গ্রামে এ আমের অসংখ্য বাগান গড়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে জমিদার বিনোদ কুমার লাহিড়ীর উত্তরসূরি নাতি শ্রী নিহার রঞ্জন লাহিড়ী বলেন, আমার দাদু বিনোদ কুমার লাহিড়ী বহুকাল আগে তীর্থভূমি কাশীতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মুর্শিদাবাদের নবাবের বিখ্যাত আমবাগানে উদ্ভাবিত অতি উৎকৃষ্ট জাতের আম নাক ফজলি আমের কয়েকটি চারা বাংলাদেশে প্রথম এনেছিলেন। দাদু কয়েকটি নাক ফজলি আমের চারা সংগ্রহ করে ভান্ডারপুরে নিজস্ব আমবাগানে রোপণ করেন।
তিনি বলেন, এখনো অনেকেই এই আমের খোঁজখবর নিতে আমাদের কাছে আসেন। ভারত থেকে আনা ফলের চারাগুলো এখনো সে প্রজন্মের স্মৃতি হয়ে রয়েছে তাদের পরিবারের কাছে।
আমের নাম নাক ফজলি হল কেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিনোদ কুমার লাহিড়ীর স্ত্রীর নাক একটু লম্বা ছিল। আর যেহেতু আমটি তার শশুর বাড়ির এলাকা থেকে আনা হয়েছিল, সে-ই সুত্রধরে আমের নামকরণ করা হয় নাক ফজলি।’
এ বিষয়ে কোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহীনূর ইসলাম স্বপন জানান, নাক ফজলি আম এ অঞ্চলের মাটির কারণে ফলন ভালো ও সুস্বাদু হয়। প্রতি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা ভান্ডারপুর হাট থেকে আম কিনে নিয়ে যান। বর্তমানে নাক ফজলি আমের জন্য ভান্ডারপুর বিখ্যাত এলাকা।
স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ আবদুল মান্নান জানান, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বিনোদ কুমার লাহিড়ী এ দেশ থেকে সপরিবার ভারতে চলে যান। আমার দাদা তার কলকাতার সম্পত্তি বিনোদ কুমারের সঙ্গে বিনিময় করায় এই জমিগুলো আমরা পাই। তার এখনো ৫ শতাংশ জমি রয়েছে এ দেশে। যেখানে তার উত্তরসূরিরা বাস করছেন। তাদের সেই জমিদারি আর নেই।
তিনি আরও বলেন, জমিদার ভ্রমণপিপাসু মানুষ ছিলেন। পৃথিবীর যেই প্রান্তে ঘুরতে যেতেন, ফেরার পথে বিভিন্ন জাতের ফলজ বৃক্ষ নিয়ে আসতেন। তার মধ্য জনপ্রিয়তা পায় এই নাক ফজলি আম। এই আম এই মাটির জন্য প্রসিদ্ধ বলে জানান তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায় , নাক ফজলি এ অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। গাছ পাকা নাক ফজলির ঘ্রাণ জন্ম দেয় অসাধারণ এক অনুভূতির। এ আমের আরেকটি বিশেষত্ব একটু শক্ত হওয়ার কারণে সহজে পচে না । গাছ থেকে নামানো নাক ফজলি দীর্ঘদিন ধরে ঘরে রেখে খাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: নওগাঁয় দুস্থ ও ছিন্নমূলদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ
বদলগাছি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাবাব ফারহান জানান , নাক ফজলি আম লম্বায় প্রায় চার ইঞ্চি আর চওড়ায় দেড় ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর নিম্নাংশ বাঁকানো। নাক বড় এবং স্পষ্ট বেরিয়ে আসে। আমটির গড় ওজন ৩০০ গ্রাম। আকারে অনেকটা বড় এবং নাক স্পষ্ট, এ কারণে এর নাম হয়েছে নাক ফজলি। নাক ফজলি শুধু নওগাঁ জেলায় পাওয়া যায়। যার কারনে সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন) স্বীকৃতি পেয়েছে বদলগাছীর নাক ফজলি আম। এ বছর শুধু বদলগাছী উপজেলাতেই ২০ কোটি টাকার উপরে আম বাণিজ্যের সম্ভাবনা রয়েছে।
এসডি/