জাপান সফর শেষে দেশে ফিরছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৫৫ অপরাহ্ন, ৩১শে মে ২০২৫

চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে জাপান থেকে দেশে ফিরছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শনিবার (৩১ মে) জাপানের স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ২০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিট) তিনি ঢাকা ফেরার উদ্দেশ্যে জাপান ত্যাগ করেন। এর আগে তিনি মঙ্গলবার (২৭ মে) দিবাগত রাত ২টা ১০ মিনিটে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টোকিওর উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন।
চারদিনের এই সফরে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব এবং ভবিষ্যৎ কৌশলগত সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। বৈঠকে দুই দেশের বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ককে আরও গভীর ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও প্রতিশ্রুতি গৃহীত হয়।
আরও পড়ুন: নিজের মঙ্গল ও দেশের কল্যাণে তামাক বর্জন জরুরি: আসিফ মাহমুদ
বৈঠকে উভয় নেতা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি আর্থ-রাজনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (Economic Partnership Agreement - EPA) স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, যা চলতি বছরের মধ্যেই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে। এই চুক্তির মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও সহজতর হবে, শুল্ক বাধা হ্রাস পাবে এবং দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সফরকালে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয়। এসব সমঝোতা স্মারক শিক্ষা, অবকাঠামো, জ্বালানি, দক্ষ জনশক্তি, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে গঠিত হয়েছে। এতে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্বের ভিত্তি আরও শক্তিশালী হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছেন।
২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের বিষয়টি উল্লেখ করে ড. ইউনূস জাপান সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান, যেন বাংলাদেশের জন্য কমপক্ষে আরও তিন বছর শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় রাখা হয়। তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকে স্থিতিশীল রাখতে এই সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন: ১০০ ব্যবসায়ী নিয়ে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ঢাকা সফরে এলেন
বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য জাপানের সহায়তা কামনা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ
মহেশখালীতে এলপিজি আমদানি টার্মিনাল নির্মাণ
ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীতকরণ
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন
মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর চার লেনবিশিষ্ট নতুন সেতু নির্মাণ
এই প্রকল্পগুলোর জন্য জাপানের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা চাওয়া হয়েছে। জাপান ইতোমধ্যেই এসব প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে সূত্র জানায়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাপানি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি বিশেষভাবে অটোমোবাইল, বৈদ্যুতিক যানবাহন, হালকা যন্ত্রপাতি, উচ্চ প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক্স এবং সৌরশক্তি খাতে জাপানি বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে (SEZ) জাপানি প্রতিষ্ঠানের জন্য উদার নীতিমালা এবং সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন তিনি।
আরও পড়ুন: তিস্তার পানি বাড়ায় ভারতে রেড অ্যালার্ট, সতর্কবার্তা বাংলাদেশেও
বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর সম্ভাবনা তুলে ধরে ড. ইউনূস জাপানে ‘বাংলাদেশ-জাপান স্কিলড ওয়ার্কফোর্স পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম’ চালুর প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাব গৃহীত হলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের দরজা খুলবে এবং জাপানে বয়োজ্যেষ্ঠ জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে শ্রম ঘাটতি মোকাবেলায় এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
প্রধান উপদেষ্টা জাপানের কাছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বাড়ানো, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, এবং প্রশিক্ষকদের জাপানে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জ্ঞান ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়নে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক একটি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। দুই দেশের মধ্যে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে শুধু কৌশলগত অংশীদারত্বই নয়, বরং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও একটি উদাহরণ তৈরি করবে। অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে এই সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পালাবদল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এমএল/