প্রবাসীদের আস্থার প্রতীক: সাইফুল রাজীব
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:৫৪ পিএম, ১৮ই আগস্ট ২০২৫

হাজার মাইল দূরের প্রবাস জীবনের গল্পে থাকে ঘাম, চোখের পানি আর না বলা কষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা দিনের পর দিন পরিবার থেকে দূরে থেকে সংগ্রাম করেন জীবিকার জন্য। কিন্তু এই লড়াইয়ে যখন কাউকে পাশে পাওয়া যায়, তখন সেই মানুষটিই হয়ে ওঠেন ভরসার আর আশ্রয়ের নাম।
ঠিক এমনই একজন মানুষ সাইফুল রাজীব। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় যিনি এখন পরিচিত এক নাম। প্রবাসীদের কাছে তিনি শুধু একজন সাংবাদিক নন, বরং আস্থা, বিশ্বাস ও গর্বের প্রতীক।
বিমানবন্দরে মরদেহ, লাইভে তথ্যসেবা:
তার সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই বোঝা যায় কেন তিনি প্রবাসীদের হৃদয়ের মানুষ। কখনো বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে মরদেহ গ্রহণ করছেন শোকার্ত স্বজনদের সঙ্গে, কখনো নির্যাতিত প্রবাসীদের নিয়ে ছুটছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। আবার কখনো দেখা যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে প্রবাসী পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন তিনি।
করোনা মহামারীর অচেনা অন্ধকারে যখন প্রবাসীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিলেন, তখন হাজারেরও বেশি ফেসবুক লাইভ করে তিনি জানাতেন প্রয়োজনীয় তথ্য। কোন শহরে কতজন আক্রান্ত, ফ্লাইট কবে বন্ধ হচ্ছে, আবার কবে চালু হবে—এসব তথ্য পেতে প্রতিদিন হাজারো প্রবাসী অপেক্ষা করতেন তার লাইভের জন্য।
আরও পড়ুন: মৎস্য খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি: খাদ্যনিরাপত্তা ও রপ্তানি সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত: সাকিফ শামীম
প্রবাস জীবন থেকে সাংবাদিকতার পথে:
২০০৮ সালে সাধারণ কর্মী ভিসায় সৌদি আরব পাড়ি দিয়েছিলেন সাইফুল রাজীব। কিন্তু তিনি কেবল নিজের জীবন গড়ার চিন্তায় আটকে থাকেননি, বরং চোখ মেলেছিলেন চারপাশের প্রবাসী সমাজের দিকে। দেখেছেন কষ্ট, শুনেছেন হাহাকার। সেখান থেকেই সাংবাদিকতায় আসা। টানা চার বছর বাংলা টিভির জেদ্দা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
তবে দুই–তিন মিনিটের টেলিভিশন রিপোর্টে প্রবাসীদের যন্ত্রণার দীর্ঘকথা ধরা যায় না। তাই ২০১৮ সালে তিনি খোলেন ফেসবুক পেজ “প্রবাসের সাতকাহন – সাইফুল রাজীব”। একসময় যা হয়ে ওঠে প্রবাসীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার। বর্তমানে এর অনুসারী সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।
আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা:
সৌদি আরবে অবস্থানকালে তিনি যে আস্থা তৈরি করেছিলেন, তা তাকে একসময় প্রবাসীদের চোখে ‘সবকিছু পারার মানুষ’ বানিয়ে তোলে। যদিও তিনি বারবার বলতেন—“সব কিছু আমার পক্ষে সম্ভব নয়, অনেক কিছুই আইনের সীমাবদ্ধতায় আটকে যায়।” তবুও প্রবাসীরা বিশ্বাস করতেন, সাইফুল রাজীব চাইলেই সমাধান খুঁজে পাবেন।
এই বিশ্বাসই একসময় কিছু অসাধু কনস্যুলেট কর্মকর্তার চোখে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের মিথ্যা অভিযোগে ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট সাইফুল রাজীব গ্রেফতার হন সৌদি প্রশাসনের হাতে। কাটাতে হয় দীর্ঘ ৮৮ দিন জেলে। এরপর ২৫ নভেম্বর তিনি দেশে ফেরেন।
আরও পড়ুন: জনসংখ্যা থেকে জনসম্পদ: আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও রোডম্যাপ
দেশে ফিরে নতুন পথচলা:
দেশে ফিরে প্রথমে কিছুদিন এশিয়ান টিভিতে কাজ করলেও দ্রুত বুঝতে পারেন—প্রতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে প্রবাসীদের জন্য বড় পরিসরে কাজ সম্ভব নয়। তাই স্বাধীনভাবে নিজের পথ বেছে নেন।
২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশ করেন তার বই “প্রবাসের সাতকাহন”, যেখানে একযুগের অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের বাস্তবচিত্র।
২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি—
১৭ জন নির্যাতিত নারী কর্মীকে দেশে ফেরত এনেছেন
২৫ জন অসুস্থ প্রবাসীকে দেশে ফিরিয়েছেন
২৯ জন প্রবাসীর মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করেছেন
এসব কাজে সহযোগিতা করেছেন সাধারণ প্রবাসী, দূতাবাস, কনস্যুলেট, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও এনজিও ব্র্যাক।
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথে
প্রবাসীদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিবাদ জানাচ্ছেন সাইফুল রাজীব। ফ্রি ভিসার নামে প্রতারণা, মানবপাচার কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন বারবার। এর ফলেও নেমে এসেছে নানা বিপদ। মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে তাকে, কখনো সিআইডি তুলে নিয়ে গেছে, নিয়মিত আসছে হুমকি।
আরও পড়ুন: আধুনিক কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি: সাকিফ শামীম
তবুও থেমে নেই তিনি। একরাশ দৃঢ়তায় তিনি বলছেন—
“আমি নিজেও প্রবাসী ছিলাম। তাই তাদের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি তারা কী বলতে চায়। আমি চাই না কোনো প্রবাসী ভুল তথ্যের কারণে বিপদে পড়ুক। যতদিন পারি, তাদের পাশে থাকতে চাই।”
মানুষের ভালোবাসায় এগিয়ে চলা
আজ প্রবাসীরা তাকে মনে করেন তাদের পরিবারের একজন। কারণ তিনি প্রমাণ করেছেন—প্রবাসের দূরত্বে থেকেও মমত্ববোধের সুতো বোনা যায়, আর সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা মানে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার সত্যনগর গ্রামে জন্ম নেওয়া সেনাসদস্যের সন্তান সাইফুল রাজীব এখন শুধু গ্রামের নয়, পুরো প্রবাসী সমাজের গর্ব।
প্রবাসীদের ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আশীর্বাদকে পুঁজি করে তিনি এগিয়ে চলেছেন নিজের পথ ধরে। তার হাতে গড়া ফেসবুক পেজ “প্রবাসের সাতকাহন – সাইফুল রাজীব” আর ইউটিউব চ্যানেল “ঈযধহহবষ ঝধঃশধযড়হ”-এ ভর করে আজ লাখো প্রবাসীর আশা জেগে ওঠে।
প্রবাসীদের জীবনে তিনি যেন এক আলোকবর্তিকা—অন্ধকারে পথ দেখানো এক সাহসী মানুষ।
এমএল/