ডিমলায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে নৈরাজ্য
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪:০৭ পূর্বাহ্ন, ১১ই মার্চ ২০২৩
নীলফামারীর ডিমলায় অনিয়ম-দুর্নীতি-জালিয়াতির মাধ্যমে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার নামে সরকারি অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে উপজেলায় ঝড়েপড়া শিক্ষার্থী নিয়ে ৯০টি কেন্দ্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৭০টি ও ইনসিওর প্রকল্পের আওতায় ২০টি।দুর্নীতি-জালিয়াতির মাধ্যমে ঝরে পড়া নয়-এমন শিক্ষার্থীদের দেখিয়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৯০টি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি স্কুলে ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী থাকবে। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এখানে ভর্তি করা যাবে না। ছাত্রছাত্রীর বয়স হবে ৮ থেকে ১৪ বছর। নানা সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের মাসিক ভাতা জনপ্রতি ১২০ টাকা করে ৩৬ মাস, ফ্যান কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ আছে।
সরেজমিনে দেখা যায় একেবারেই উল্টোচিত্র। ফ্যান থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের কিছুই দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ স্কুল করা হয়েছে বিভিন্নজনের বারান্দায়, গোয়ালঘর, রান্নাঘর বা গোডাউনে। এসব জায়গায় সাইনবোর্ড থাকলেও ক্লাস হয় না। কোনো স্কুলেই ৩০ জন শিক্ষার্থী নেই। কয়েকটি স্কুল চললেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭-৮ জন। তারাও অন্য প্রতিষ্ঠানের।
অভিযোগ রয়েছে, গোজামিল দিয়ে শিক্ষার্থী কোটা পুরণ করেছে দায়িত্ব পাওয়া এনজিও গন উন্নয়ন কেন্দ্র (গার্ক)। ঝরে পড়া নয় এমন শিক্ষার্থীদের দেখিয়ে এসব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে কার্যক্রম চলছে। রেজিস্টার খাতায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষার্থীর নাম উঠিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সংস্থার স্কুলকে উপানুষ্ঠানিক কেন্দ্র দেখানো হয়েছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, এ উপজেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৭৬ জনের কাছাকাছি। শিক্ষা বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর হার এক দশমিক তিন শতাংশ। এই পরিসংখ্যানের বিপরীতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প ঝরেপড়া শিক্ষার্থী দেখিয়েছে ২৫০০ জন। যা শিক্ষা বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে।
জানা যায়, এসব শিক্ষার্থীদের প্রতিমাসে ৩টি করে খাতা দেয়ার কথা থাকলেও গত ১৪ মাসে মাত্র দুইবার খাতা দেয়া হয়েছে। প্রতিটি খাতার দাম ২৫ টাকা হিসাবে না দেয়া খাতার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ টাকা।অধিকাংশ কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক পাখা দেখা যায়নি।স্কুল ঘর বাবদ প্রতি মাসে ১৫'শ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ৬ থেকে ৮'শত টাকা।
তাছাড়া স্কুল পোশাক, শ্রেনী কক্ষের ম্যাটসহ ৩২ প্রকার উপকরণ কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ থাকলেও বই ছাড়া শিক্ষার্থীদের কিছুই দেওয়া হয়নি।
সদর ইউনিয়নের মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই একটি গুদাম ঘরে বাবুরহাট উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র।কক্ষে বিদ্যুত সংযোগ নেই। ক্লাস করছে চার শিশু। তাদের মধ্যে একজন মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। স্কুলের শিক্ষক জয়া রানী জানান, এখন তো সবাই স্কুলে যায়। ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী কোথায় পাবো।
ডিমলা নিজপাড়া উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রে দেখা যায়, ১৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র দুইজন ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। অবশিষ্ট ১৩ জন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী।
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের মাদ্রাসা পাড়া উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রটি করা হয়েছে মৌসুমী আক্তারের বাড়িতে। তিনিই ওই কেন্দ্রে শিক্ষক। সকাল ১১টায় দেখা যায় ওই কেন্দ্রে কোনো শিক্ষার্থী নেই।
মৌসুমি বলেন ,এখনও বই পায়নি তাই শিক্ষার্থী আসেনা। আর ঘর ভাড়া বাবদ তিনি ৮'শত টাকা পান।
একই ইউনিয়নের লালকুড়া মেম্বারপাড়া উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রটি বন্ধ পাওয়া যায়।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অধিকাংশ শিক্ষাকেন্দ্রে ৮ বছরের কম বয়সী শিশু ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম দেখানো হয়েছে। এ চিত্র সারা উপজেলায়।
রুপাহারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মন্জুয়ারা বেগম, নুর হিরাসহ কয়েকটি বিদ্যালয়ের অন্তত ২০ জন শিক্ষক জানান, তাঁদের বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষার্থী দেখিয়ে উপানুষ্ঠানিক স্কুল চালানো হচ্ছে। আমাদের চতুর্থ-পন্ঞ্চম শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের প্রলোভন দেখিয়ে তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করছে। এতে শিক্ষার্থীদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এসব বিষয়ে অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছে না।
ঘুঘুডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিজল ইসলাম বলেন, আমার বিদ্যালয়ের ১৬ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করেছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
কামারেরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তাহেদুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিও অনভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে স্কুল পরিচালনা করছে। তারা আমাদের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে ভর্তি করছে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার মান নষ্ট হচ্ছে ।অন্যদিকে ওই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।তিনি বলেন,বর্তমানে প্রয়োজনের অধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। তারপরও এসব স্কুলের অনুমোদন দেওয়া অর্থহীন।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন,সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করতেই এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম কেন্দ্রগুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
গন উন্নয়ন কেন্দ্রের নিয়োগপ্রাপ্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, খাতা-কলমে ২৫ থেকে ৩০ জন থাকলেও শিক্ষাকেন্দ্রে আসে আট থেকে দশজন। তাদের মধ্যে মাত্র দু-একজন ঝরে পড়া শিক্ষার্থী।
গন উন্নয়ন কেন্দ্রের উপজেলা কার্যক্রম পরিচালক সন্তোষ কুমার বলেন, তাঁরা এখনও টাকা পাননি, জেলা কার্যক্রম পরিচালক আব্দুস সাত্তার বলেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে অনিয়ম হলে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। তবে প্রকল্প গ্রহণে কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের জরিপ অনুযায়ী, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৭৬ জন, কিন্তু ৯০ কেন্দ্রে আড়াই হাজার শিক্ষার্থী কোথায় থেকে এসেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,উপজেলার স্বতন্ত্র যাচাই বাছাই সংস্থা(আইভিএ)'র জরিপে এই পরিসংখ্যন উঠে এসেছে। শিক্ষা অফিসের জরিপ ভুল।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বলেন,ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর তালিকা পুরোপুরি ভুয়া।কীভাবে তালিকা অনুমোদন পেল এটা আমি বলতে পারব ন। আমার উপজেলায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৭৬ জন। বাকি দুই হাজার শিক্ষার্থী তারা কোথায় পেল। তিনি বলেন, শুনেছি অনেকের নাম, বাবার নাম আছে কিন্তু বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই এমন ছাত্র তালিকায় রয়েছে। এছাড়া এক এলাকার ছাত্র অন্য এলাকায় দেখিয়ে কেবল সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসব কারণে তারা আমাদের সাথে কোন সমন্বয় করেনি। অনুমোদনও নেয়নি। আমি বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাবো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, সরেজমিনে তদন্ত করে কোন অনিয়ম পাওয়া গেলে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কার্যক্রম এই উপজেলায় বন্ধের জন্য সুপারিশ করা হবে।