ছেলের চেয়ে বাবার বয়স কম! বিনা চিকিৎসায় বীর মুক্তিযোদ্ধার করুণ মৃত্যু
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, ছেলের চেয়ে বয়সে ছোট বাবা। সন্তানের জন্মের ১০ বছর পর জন্ম তারিখ দেয়া হয়েছে বাবার! জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখের এমন অসঙ্গতি দেখা গেছে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী ও তার ছেলে আমির হোসেনের। জন্ম তারিখের এই জটিলতার কারণে প্রায় দুই বছর যাবত বন্ধ রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা।
পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে কাজ হয়নি। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন ৯৪ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী।
জানা গেছে, ভূরুঙ্গমারী উপজেলার চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ধুলার কুটি গ্রামের মৃত বাবন শেখের ছেলে আকবর আলী প্রায় ৪৩ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। সেই সময় তিনি বিবাহিত ছিলেন। তার সাত সন্তানের মধ্যে তিন সন্তান মুক্তিযুদ্ধের আগেই জন্ম গ্রহণ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকার ১৭ নং বইয়ের ৪০১৪৭ ক্রমিকে, লাল মুক্তিবার্তায় ৩১৬০৪০৫২০ ক্রমিকে এবং ২০০৫ সালের ২১ মের বেসামরিক গেজেটের ৩৭৯১ পৃষ্ঠায় গেজেট নং ১০৬৪ এ আকবর আলীর নাম রয়েছে।
তিনি ২০০৮ সালের ১ অক্টোবর হতে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছিলেন। ২০২০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য অনলাইনে পূরণ করতে গিয়ে জন্ম তারিখের ত্রুটির কারণে তিনি ভাতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।
জন্ম সনদ অনুযায়ী আকবর আলীর জন্ম ১৯২৮ সালের ১১ আগষ্ট। কিন্তু ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১৯৭১ সালের ১০মে। অপরদিকে তার বড় ছেলে আমির হোসেনের জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১৯৬০ সালের ২ মার্চ। জাতীয় পরিচয়পত্রের এমন ত্রুটির কারণে প্রায় দুই বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ রয়েছে এই মুক্তিযোদ্ধার।
জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য নির্বাচন অফিসসহ বিভিন্ন দফতরে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি আকবর আলীর সন্তানদের। জন্ম তারিখ সংশোধন হওয়ার আগেই চলতি বছরের গত ৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলী বলেন, আকবর আলী, লস্কর আলী ও আমি সম্পর্কে জেঠাতো ভাই। তিনজনই যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়েছি। ভোটার আইডির সমস্যায় আকবর আলীর ভাতা বন্ধ হয়ে যায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী সুফিয়া বেওয়া বলেন, ‘ভাতা বন্ধ হওয়ার পরে উনি অসুস্থ হইয়া পড়ল। ঠিকমত চিকিৎসাপাতি করাইতে পারলাম না। অসুস্থ হইয়া উনি মইরাই গেল। অফিসে-অফিসে অনেক দৌঁড়াইছি কেউ সারা দেয় নাই।’
বড় ছেলে আমির হোসেন বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় বাবার জন্ম দিছে ১৯৭১ সালে। আমাদের ভাই-বোনদের জন্ম সাল দিছে ১৯৫০ সাল, ১৯৬০ সাল। জন্ম তারিখ ঠিক করার জন্য যেখানেই গেছি খালি ট্যাহা-ট্যাহা করে। বাবার জন্ম তারিখ ঠিক হয়নি। আমরা ব্যর্থ হইয়া গেছি।'
বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর নাতি রঞ্জু বলেন, ‘আমার দাদা-দাদী ২০০৮ সালে এনআইডি করতে গেলে তাদের বয়স ভুল তোলা হয়েছিল। দাদার বয়স ঠিক করতে আমরা ঢাকা গেছি। সেখানে বলা হয়, এটা রংপুর থেকে ঠিক করবে। রংপুর গেছি, সেখানে আমরা পাত্তাই পাই নাই। দাদা মারাই গেল। ভাতা বন্ধ হয়ে রয়েছে। অন্যের ভুলের খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে।'
চর ভূরুঙ্গামারী ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মরহুম আকবর আলী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তার বয়স ঠিক করার জন্য আমরা বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেন হলো না, তার সঠিক কারণ আমরা জানি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি সঠিক তদন্ত করে মৃত আকবর আলীর ভাতা পূণরায় চালুর ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম রাকিব বলেন, ‘’বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর জন্ম তারিখ সংশোধনের আবেদনটি ‘গ' ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। ইতোমধ্যে এই আবেদনটি নিষ্পত্তি করার জন্য প্রয়োজনীয় তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।’’
রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা জিএম সাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘দ্রুত বিষয়টির সমাধান করা হবে।’
এসএ/