ব্যবসার নামে ধান্দায় মত্ত অকুলিন টেক


Janobani

বশির হোসেন খান

প্রকাশ: ০৪:০৪ অপরাহ্ন, ১৯শে এপ্রিল ২০২৫


ব্যবসার নামে ধান্দায় মত্ত অকুলিন টেক
ছবি: পত্রিকা থেকে নেওয়া ।

# কারসাজি করে বাগিয়ে নেয় কাজ

# তদবির ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে

# শেখ রেহানার ছেলে ববির বন্ধু সাজিদ হন কোম্পানির এমডি

# প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার

# দুর্নীতি কমিয়ে আনতে দরকার সদিচ্ছা

ড. মো. আব্দুল মোমেন, চেয়ারম্যান, দুদক 

# রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিবাজরা সক্রিয়

- ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি


দেশের বিদ্যুৎ খাতে অন্যতম ধান্দাবাজ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে অকুলিন টেক বিডি লিমিটেড। ২০১৯ সালে নতুন এ কোম্পানীর আবির্ভাব হয়। শেখ রেহানার ছেলে ববির সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে শাদাব সাজিদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এই কোম্পানী শুরু করেন বিদ্যুৎ ও আইটি খাতে বিশাল অংকের প্রকল্প হাতিয়ে নিতে। শুরুতে এসেই তারা বাংলাদেশের সকল বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার বিশাল অংকের কাজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে ঝাপিয়ে পড়ে। 


পরিকল্পনা হয় প্রতিটি সরকারি সংস্থা সব মিটার প্রকল্প এবং নতুন প্রকল্প বানাবে তাদের জন্য। আমলাদের মধ্যে তাদের সাথে ছিলেন আহমদ কায়কাউস, তৎকালীন বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব। পরবর্তীতে তার এই ভূমিকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হন।


প্রিপেইড মিটার স্থাপনের বিভিন্ন প্রকল্প সেসময় চলমান ছিলো। নতুন কিছু বাজারে এনে প্রকল্প বানানোর জন্য তারা একটি গল্প ফাঁদে যার নাম ‘অ্যাডভান্স মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার (এএমআই)’ কনসেপ্ট। তারা প্রচার করে এতে থাকবে ইউরোপিয়ান এএমআই স্মার্ট মিটার, আরএফ মেশ প্রযুক্তি, নিক কার্ড, এমডিএমএস (মিটার ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম), ওরাকল ডাটাবেস ইত্যাদি যাতে সকল সুবিধা পাওয়া যাবে অনলাইনে। সর্বপ্রথম অকুলিন নজর দেয় ডিপিডিসির সাড়ে ৮ লাখ প্রিপেইড মিটার প্রকল্পে। পিছনে কলকাঠি নেড়ে প্রকল্পের দরপত্র হওয়ার আগেই অকুলিন কাজ পাবে তা প্রায় পূর্বঘোষিত ছিলো। সেই অনুযায়ী শর্ত দিয়ে ডিপিডিসিকে দিয়ে দরপত্র করানো হয়। সাজানো টেন্ডার করে কাজ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্টদের তুষ্ট করতে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিপিডিসি, নেসকো, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে শুরু করে প্রায় সব সংস্থা এই নামসর্বস্ব এএমআই প্রকল্প করে। প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের ভয়ে তটস্থ হয়ে বিশাল অংকের এই প্রকল্পগুলো করা হলেও সুফল মেলেনি। ইউরোপীয়ান দামী পণ্যের ব্যপারে প্রচারণা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রকল্পে সরবরাহ করা হয় চাইনিজ এবং ইন্ডিয়ান মিটার। আরএফ মেশ প্রযুক্তি ব্যর্থ হয়। এমডিএমএস সিস্টেমের মাধ্যমে আজও মিটার অনলাইনে আসেনি।


অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, অকুলিন টেক বিডি বা তাদের ছত্রছায়ায় যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে তাতে অবাধ প্রতিযোগিতা হয়নি। দরপত্রদাতার সংখ্যা আকষ্মিকভাবে কম। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায় দরপত্রে বিশেষ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়ায় দেশী-বিদেশী অনেক কোম্পানী অংশগ্রহণ করতে পারেনি। প্রতিযোগিতা কমিয়ে অকুলিন নামক কোম্পানীকে প্রকল্প দিতে বিচিত্র কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিলো প্রকল্পে। যার মধ্যে একটি- গার্টনারের লিস্টে কোম্পানীর নাম থাকতে হবে যা খুবই স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের আছে। এছাড়া ওরাকল লাইসেন্স এর অথারাইজেশন অবশ্যই থাকতে হবে। বাংলাদেশে ওরাকল শুধুমাত্র অকুলিনকেই তাদের সিস্টেম ও লাইসেন্সের ব্যবসার অথারাইজেশন দিয়ে রেখেছিলো। তাই প্রকৃতপক্ষে অকুলিন টেক ছাড়া এইসব টেন্ডারে কেউই অংশগ্রহণ পারবে না। তাই এএমআই শীর্ষক প্রকল্পগুলো সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে অকুলিন।


প্রজেক্টের মাধ্যমে বেশি টাকা বের করে নেওয়ার জন্য প্রতি মিটারের জন্য লাইসেন্সের খাত করে তারা। এছাড়া আরো শর্ত থাকে যে সিস্টেমের সাথে ইন্ট্রিগ্রেশন থাকতে হবে। অকুলিন টেক প্রতিটি বিতরণ সংস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে সিস্টেম আজ অবধি সঠিকভাবে তৈরী করতে পারেনি। এই সকম এএমআই প্রকল্পে অকুলিন টেকের ছত্রছায়য় মুষ্টিমেয় কিছু কোম্পানি সব মিটার সরবরাহ করে। যার মধ্যে নাম জানা যায় শেনঝেন স্টার ও ওয়াশিওয়ন নামের চীনের দুটি কোম্পানির। ডিপিডিসি, নেসকো, বিউবো, বিআরইবির এই প্রকল্পগুলোতে খরচ হয়েছে অস্বাভাবিক।


এ ব্যাপারে ওকুলিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাদাব সাজিদ সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ওকুলিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হামান ইমাম এর মুঠো ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি। বরং ক্ষুর্দে বার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি। 


প্রতিষ্ঠানের সাবেক একজন কর্মকর্তা জানান এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বছরের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থেকেই কলকাঠি নাড়তেন।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, নামসর্বস্ব এই কোম্পানি যেসব টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতো সেসব টেন্ডারে কেবল একটি বা দুটি কোম্পানি অংশগ্রহণ করতো। সেটিও ছায়া প্রতিষ্ঠান। মূলত অকুলিন তার সিন্ডিকেট নিয়ে অংশগ্রহণ করতো। একটি টেন্ডারে অকুলিন-ওরাকল, আরেকটিতে আইট্রন-এসকিউ। 


মিটার নামমাত্র হলেও সফটওয়্যার এবং লাইসেন্সের নামে প্রচুর টাকা লুট করেছে এই প্রতিষ্ঠান। তাদের ছত্রছায়ায় থাকা কোম্পানিগুলোকে কাজ পেতে ও করতে প্রকল্পের একটি বড় অংশ তাদের হংকং একাউন্টে টাকা পাঠাতে হতো। এভাবে প্রচুর টাকা পাচার করেছে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা।


দুর্নীতি কমিয়ে আনতে দরকার সদিচ্ছা: সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুল মোমেন বলেছেন, “আমাদের আকাঙ্ক্ষা হলো একটা ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠিত হোক। সেই ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ যদি গঠিত হতে হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে দুর্নীতি একেবারে নির্মূল হবে এখনো সেটা মনে করি না। দুর্নীতি সেই পুরোনো আমলেও ছিল, অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু আমরা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারব। তার জন্য দরকার হচ্ছে আমাদের সদিচ্ছা।”


এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, “দুর্নীতিবাজরা যতই ক্ষমতাধর হউক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।”  


এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দুর্নীতিবাজরা সক্রিয় থাকে। চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।” 


আরএক্স/