সার আমদানিতে অর্থ লুটের ছক

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার আমদানির সাম্প্রতিক কার্যাদেশ ঘিরে যে অনিয়মের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, সেটি নিছক কোনো প্রশাসনিক ত্রুটি নয় বরং রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাটের এক অভিনব কৌশল। সরকারি খাতে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়, কিন্তু এই ঘটনায় যে প্রক্রিয়ায় একই প্রতিষ্ঠানকে একই ধরনের সার ভিন্ন ভিন্ন দরে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, তা নজিরবিহীন বলেই অভিহিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ যেন আয়োজন করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের এক মহাযজ্ঞ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর (২০২৫-২৬) এ কৃষি মন্ত্রণালয় সার আমদানির ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী, সর্বনিম্ন দরদাতার প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যাদেশ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও, এই ক্ষেত্রে নেগোসিয়েশন নামের একটি প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন দরে কার্যাদেশ অনুমোদন করা হয়েছে। এর ফলে একই প্রতিষ্ঠান একই ধরনের সার তিন দামে আমদানির সুযোগ পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দুটি কার্যাদেশে মোট ৮০,০০০ টন ডিএপি সার আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। প্রথম কার্যাদেশে প্রতিষ্ঠানটিকে ৪০,০০০ টন ডিএপি সার আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, যেখানে মিশর থেকে আমদানির দাম ধরা হয় টনপ্রতি ৮৭৪ মার্কিন ডলার এবং চীন থেকে ৮৪৮ মার্কিন ডলার। অপর কার্যাদেশে আবার একই প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয় ৪০,০০০ টন ডিএপি সার আমদানির জন্য, যেখানে রাশিয়া থেকে আমদানির দাম ধরা হয় টনপ্রতি ৮৬৫ ডলার এবং চীন থেকে ৮৪৮ ডলার। অর্থাৎ একই সার, একই প্রতিষ্ঠান । অথচ তিনটি ভিন্ন দাম।
অন্যদিকে, একই সময়ে এনআরকে হোল্ডিং নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকেও ৪০,০০০ টন ডিএপি সার আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, যেখানে দাম নির্ধারণ করা হয় টনপ্রতি ৮৪৮ ডলার। শুধু ডিএপি নয়, টিএসপি সারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের বৈপরীত্য ধরা পড়েছে। দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশনকে ৩০,০০০ টন টিএসপি সার আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, যেখানে মরক্কো থেকে আমদানির দাম ধরা হয় টনপ্রতি ৬৯৪ ডলার এবং লেবানন থেকে ৬৮৮ ডলার। কিন্তু একই সময়ে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে দুই কার্যাদেশে মোট ৬০,০০০ টন টিএসপি সার আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, যেখানে দাম নির্ধারণ করা হয় ঠিক একইভাবে। মরক্কো থেকে ৬৯৪ ডলার ও লেবানন থেকে ৬৮৮ ডলার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানভেদে কার্যাদেশের সংখ্যা এবং শর্তের মধ্যে পার্থক্য থাকায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এই কার্যাদেশগুলো জারি করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা। প্রতিবেদকের হাতে আসা অনুলিপিতে দেখা গেছে, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে এসব কার্যাদেশ জারি করা হয়। কার্যাদেশে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জামানতের অর্থ জমা দিতে হবে এবং ঋণপত্র খুলতে হবে। সেই সঙ্গে টনপ্রতি ১,৫০০ টাকা স্থানীয় ব্যয় এবং ১৩ শতাংশ সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হয়। আমদানিকৃত সার নির্দিষ্ট মোকামে সংরক্ষণ ও ডিলার পর্যায়ে বিতরণের বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু মূল প্রশ্ন রয়ে যায় কেন একই প্রতিষ্ঠানকে তিন দামে কার্যাদেশ দেওয়া হলো।
অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমন নজির তারা আগে দেখেননি। সাধারণত দরপত্রে সর্বনিম্ন দরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অথচ এখানে নেগোসিয়েশনের নামে ভিন্ন দরে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি অনিয়ম ও রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। এক জ্যেষ্ঠ অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, একই পণ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দামে কার্যাদেশ দেওয়া মানেই অযৌক্তিক ব্যয় এবং সরকারি অর্থ লোপাট।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তবে মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ানকেই ভরসা করা হয়। মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানাচ্ছে, উপদেষ্টার অগোচরেই এই কার্যাদেশগুলো সম্পন্ন হয়েছে। ফলে সন্দেহ জাগছে, মন্ত্রণালয়ের ভেতরকার একটি অংশ সচেতনভাবেই এ ধরনের অনিয়মের পথ তৈরি করেছে।
ডিএপি ও টিএসপি সারের কার্যাদেশে ভিন্ন দরে অনুমোদনের কারণে সরকারের অতিরিক্ত কত কোটি টাকা ব্যয় হবে, তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে হিসাব হয়নি। তবে প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, টনপ্রতি মাত্র ১০ ডলারের ভিন্নতা হলেও এক লাখ টনের বেশি সার আমদানিতে কয়েকশ কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় তৈরি হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভর্তুকি নির্ভর কৃষি খাতের জন্য এটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, কৃষকের জন্য ভর্তুকিযুক্ত সার সরবরাহ করা হয় সরকারি অর্থে। কিন্তু যদি সেই অর্থের যথেচ্ছ অপচয় হয়, তাহলে এর বোঝা সরাসরি সরকারি কোষাগারে পড়বে। এর ফলে ভর্তুকি ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে এবং কৃষকের জন্য সার সরবরাহ অনিশ্চিত হতে পারে।
একজন সাবেক কৃষি সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সার আমদানির প্রক্রিয়ায় যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তবে দেশের কৃষি উৎপাদন ও ভর্তুকি নীতি দুটোই হুমকির মুখে পড়বে। তিনি আরও বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়মের উদাহরণ পাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক।
প্রাপ্ত কার্যাদেশে আরও দেখা যায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সোনালী ব্যাংকের ডলার-টাকা রেট অনুযায়ী হিসাব করতে হবে। ঋণপত্র খোলা, স্থানীয় ব্যয় এবং সুদের হার নির্ধারণ করা হলেও, কার্যাদেশের মূল অসঙ্গতি থেকে গেছে। কেন একই প্রতিষ্ঠানের জন্য ভিন্ন দরে অনুমোদন দেওয়া হলো, তার কোনো স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এটি শুধু প্রশাসনিক ব্যত্যয় নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ের এক বড় উদাহরণ। কার্যাদেশে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, একই সার ভিন্ন দরে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা কোনোভাবেই ন্যায্য নয়। এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে। কারা এই প্রক্রিয়ায় লাভবান হলো? রাষ্ট্রের অর্থের কত বড় অংশ অপচয় হলো? আর এর দায়ভার কে নেবে? কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভেতরে যে যোগসাজশে এমন কার্যাদেশ জারি হলো, সেটি শুধু কৃষি খাতের নয়, গোটা সরকারি ব্যবস্থার সুশাসন নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে।
সার আমদানিতে এই ধরনের অনিয়ম প্রমাণ করে, সরকারের অর্থব্যবস্থার ভেতরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। কৃষি খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতে এভাবে অর্থ লোপাট হলে, তার প্রভাব পড়বে কৃষক থেকে শুরু করে পুরো অর্থনীতিতে। কারণ কৃষি ভর্তুকি মূলত কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেওয়া হয়। সেখানে যদি সরকারি অর্থই অপচয় হয়, তবে কৃষি ভর্তুকির উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, সার আমদানির কার্যাদেশে যে বৈপরীত্য দেখা গেছে, তা শুধু আজকের নয়, ভবিষ্যতের জন্যও হুঁশিয়ারি সংকেত। যদি এখনই এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল কোটি কৃষকের জীবিকা ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা দুটোই মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে।
সার আমদানিতে অর্থ লোপাটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ে সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। তিনি বলেন, কোনো অনিয়ম হয়নি। আপনারা যারা বলছেন, তারা অপপ্রচার করছেন। আপনি যেনে শুনে তার পরে লিখুন। এর পরেই তিনি ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, আপনি অপপ্রচার করলে আমি আপনাকে দেখে নিবো।
বিজ্ঞাপন
