হাসপাতালে দু'বেলাই পাঙ্গাস-আলুর দম, অসুস্থ অ্যাম্বুলেন্সটাও


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


হাসপাতালে দু'বেলাই পাঙ্গাস-আলুর দম, অসুস্থ অ্যাম্বুলেন্সটাও

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন অব্যবস্থাপনার আখড়া। নানা সমস্যায় জর্জরিত এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন রোগীরা। দুই বেলা খেতে হচ্ছে, পাঙ্গাসের ঝুল, ডাল, একপ্লেট মোটা চাউলের ভাত ও আলোর দম। সেই খাবারে রোগীর পেটই ভরে না। রোগীর বিছানা ময়লা হতে হতে যেন মাটির মত রং হয়েছে। আবার সেই বিছানায় নেই চাদর নার্সদের কাছে চাইলে আনতে বলেন বাড়ি থেকে। এদিকে, হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সও অসুস্থ। প্রায়ই নিতে হয়, মিস্ত্রীর কাছে। এমন অবস্থায় ক্ষুদ্ধ হাসপাতালে আসা সেবা প্রত্যাশীরা। 

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্হিবিভাগের গেইটেই ড্রেন। ড্রেন থেকে আসছে দুর্গন্ধ। বর্হিবিভাগের ভিতরে লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষসহ প্রায় শতাধিক মানুষ। তাদের পাশে দু'চার জন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিও দাড়িয়ে আছেন। সংবাদ কর্মী বুঝতে পেরেই সটকে পড়েন তারা। দোতলায় উঠতে গেলে সিড়ির নিচে দেখা যায়, ময়লার স্তুপ, ময়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সিড়িতেও। ওয়ার্ডে গিয়ে বেশ কয়েক জনের বিছানায় দেখা যায়নি চাদর। 

বর্হিবিভাগের সামনে কথা হয়, ঈশ্বরগঞ্জ পৌর শহর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা মো. বজলুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, “বেশ কয়েকদিন যাবত শরীরে চুলকানি তাই, ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম। দেখে কিছু ওষুধ লিখে দিছে। এরমধ্যে এক প্রকার হাসপাতাল থেকেই দিছে। বাকীগুলো কিনে নিতে বলেছেন।” 

পেটের ব্যথা নিয়ে উপজেলার ঝাটিয়া ইউনিয়ন থেকে হাসপাতালের বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন চাঁন মিয়া।  তিনি বলেন, “বেশ কয়েকদিন যাবত পেটের বেথায় ভুগছি। গ্রামের সবাই বলছে, সরকারী হাসপাতালে গেলে টাকা ছাড়া চিকিৎসা পাওয়া যায়। ডাক্তার দেখে ঔষধ লিখে দিছে, সব ঔষধ নাকি বাইরে থেকে কিনে খেতে হবে। তাহলে সরকারী হাসপাতালে এসে কি লাভ হলো।”

উপজেলার ভাল্লুকবেড় থেকে চার মাসের শিশু সন্তানকে চিকিৎসা করাতে আসছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, “মেয়ের এলার্জির ভাব দেখা দিয়েছে। টিকেট কেটে লাইনে দাড়িয়েছি, তবে এখনো ডাক্তার দেখায়নি। শুনেছি এখানে ভাল চিকিৎসা দেয়। তাই, নিজের মেয়েকে চিকিৎসা করাতে এখানে নিয়ে আসছি।”

জাহাঙ্গীর নামের এক বৃদ্ধ উপজেলার চরনিখলা থেকে চিকিৎসা নিতে এসছেন হাসপাতালে। তিনি বলেন, “বয়স হয়ে গেছে, এখন অনেক রোগ শরীরে বাসা বেধেছে। ডায়াবেটিকস, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, রক্ত পরীক্ষা ও এক্স'রে করতে হবে। ভিতরে ডায়াবেটিকস পরীক্ষা ও এক্সরে করার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সবগুলো পরীক্ষা বাইরে করতে হয়। এছাড়াও কিছু ওষুধ লিখে দিছে। সরকারী হাসপাতালে আসছি ফ্রি চিকিৎসা নিতে। এখানে দেয়ার মধ্যে এক পাতা ভিটামিন ট্যাবলেট ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।”

হাসপাতালের দু'তলায় উঠতেই দেখা যায়, সবগুলো সিট রোগীতে পরিপূর্ণ। তবে, অনেকের বিছানাতেই নেই চাদর। প্রত্যেক রোগীর সাথেই রয়েছে, দুই থেকে তিন জনকে বাড়তি মানুষ। কেউ রোগীর বিছানায় শুয়ে আছেন, আবার অনেকে রোগীর পাশেই বসে আছেন।

উপজেলার সরিষা ইউনিয়ন থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আকলিমা আক্তার। তার বোন ফাতেমা  বলেন, “যে বিছানায় রোগী শুয়ে আছেন। এমন বিছানায় নোংরা বিছানায় কোন মানুষ শুতে পারে না। বিছানার জন্য একটি চাদর চাইলে বাড়ি থেকে আনতে বলেন। ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে দুইটা ট্যাবলেট ফ্রি দিয়েছে। কেনোলাসহ স্যালাইন বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে।”

পেটের ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন উপজেলার মাইজাকান্দি এলাকার বাসিন্দা কালাম মিয়া। তিনি বলেন, “হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর দুপুরে ও রাতে এক প্লেট ভাত, ডাল ও পাঙ্গাস মাছের ঝুল দিয়েছে। তবে, যে পরিমান খাবার হাসপাতাল থেকে দেয়, তা দিয়ে কোনভাবেই একজনের পেট ভরবে না। পর দিন সকালে একটা ডিম ও রুটির নাস্তা, দুপুরে ডাল, ভাত ও আলুর দম (আলুর ঝুল) দিয়েছে। তবে, আমি মোটামোটি সুস্থ্য, বাড়িতে চলে যাব। আমার পরে যেন এমন খাবার আর কেউ না পায়। কারণ, এসব খাবার খাওয়ার যোগ্য না।”

ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের খাবারের ঠিকাদার মিন্টু  বলেন, “হাসপাতাল থেকে দেয়া সিডিউল অনুযায়ী আমি রোগীদের খাবার ও নাস্তা দেই। এর চাইতে বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।”

হাসপাতালের প্রধান সহকারী আব্দুর রশিদ জনবাণীকে বলেন, “আমাদের হাসপাতালে অনেক কিছুই অভাব আছে। সিকিউরিটি গার্ড ৭ জন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছে দু'জন। যে কারণে হাসপাতালের ভিতরে রোগীদের মোবাইল, টাকা, সোনার চেইন চুরি হয়। হাসপাতালে স্টোর নাই, পুরাতন একটা অ্যাম্বুলেন্স আছে, সেটাও প্রায়ই রাস্তায় রোগী নিয়েই নষ্ট হয়ে যায়। পরে নিজেদের টাকায় অ্যাম্বুলেন্স মেরামত করতে হয়।”

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার  ডা. সুমিত কুমার সরকার জনবাণীকে বলেন, “বর্হিবিভাগে দৈনিক প্রায় ৩০০ জন, ইমার্জেন্সিতে ১৫০ জন, হাসপাতালের ৫০ বেডে সব সময় রোগী থাকে। অনেক সময় রোগী সংকোলান করা সম্ভব হয় না।”

তিনি বলেন, “হাসপাতালে ২২ জন মেডিক্যাল অফিসার, শিশু বিশেষজ্ঞ একজন, হাসপাতালে কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) একজন ও কনসালট্যান্ট (সার্জারি) নাই, পরিসংখ্যানবিদ নাই, ফার্মাসিস্ট দুইজন, উপসহকারী মেডিক্যাল অফিসার দুইজন অর্থপেডিক্স কনসালটেন্ট একজন, গাইনী একজন, কার্ডিওলজি কনসালটেন্ট একজন, চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ একজন কর্মরতরত আছেন। এছাড়াও, নাইটগার্ড দুইজন, আয়া তিনজন, ওয়ার্ড বয় একজন, মালি একজন, সুইপার দুইজন কর্মরত আছেন।”

ডা. সুমিত আরও বলেন, “হাসপাতালে এক্সরে, ডায়াবেটিকস পরীক্ষা, বিভিন্ন ধরণের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন থাকলেও সেটি অচল। ফিল্মের কারণে বন্ধ রয়েছে এক্স'রে এদিকে হাসপাতালে শিগ্রই ওটি চালু হবে।”

নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক জন রোগীর বেড নোংরা, কোন চাদর নেই, বেডের নিচেও ময়লা এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ নূরুল হুদা খান জনবাণীকে বলেন, “বুজতে পেরেছি আপনি চাইছেন যত নেগেটিভ নিউজ আছে, তা খুঁজে বের করতে চাচ্ছেন। কিন্তু পজেটিভ অনেক কিছু আছে সেগুলোর দিকে একটু নজর দিন।”

এসএ/