ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির বিচার করবে বিএনপি
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কুইক রেন্টাল ও বিদ্যুৎ খাতে বিশেষ আইন বাতিল করবে বলে জানিয়েছে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
শনিবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কুইক রেন্টাল ও বিদ্যুৎ খাতে বিশেষ আইন বাতিল করবে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনসহ এ সংক্রান্ত সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে। রেন্টাল/কুইক রেন্টাল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন বন্ধ/বাতিল করা হবে। স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা হবে। চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। উৎপাদন ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন অতিদ্রুত স্থাপন করা হবে। বাপেক্স ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, একইসঙ্গে দেশীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনাময় গ্যাস/পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সকল দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে টেকসই ও নিরাপদ করতে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ করা হবে। বিশেষ জোর দেওয়া হবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে। বেইজ লোড পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করা হবে। বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে প্রয়োজনীয় মেরামত ও ওভারহোল্ডিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদন উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। বেগম খালেদা জিয়া কর্তৃক বিএনপি'র ভিশন- ২০৩০ তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টর উন্নয়নে ঘোষিত পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়ন করা হবে।’
ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিকল্পনা বিভ্রম ও সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বিদ্যুৎ খাতে যে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি আমদানি সংকট। সরকার দেশের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ব্যাপারে কাতার বা ওমানের সঙ্গে পুরো জ্বালানি চাহিদা মেটানের মতো দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি না করে এর অংশ বিশেষ সিঙ্গাপুরভিত্তিক স্পট জ্বালানি বাজার থেকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে সাত ডলারে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তা এখন স্পট মার্কেট থেকে ৩৮ ডলারে পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে। এতে চাপ বাড়ছে ডলারের রিজার্ভে। সম্প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলার কিনতে এখন লাগে ১২০ টাকা। দেশে ডলার সংকট সামলাতে গিয়ে স্পর্ট মার্কেটের এই জ্বালানি কেনা বন্ধ করে দেয়ার ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় লম্বা সময়ের জন্য অন্ধকার বা লোডশেডিংয়ে পড়তে হচ্ছে সকলকে।’
‘জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ‘লোডশেডিং করে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রক্ষা হলেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বিতরণ কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কবলে পড়বে। ঋণের ভারে ন্যুব্জ পিডিবি আরও রুগ্ন হয়ে পড়তে পারে। লোডশেডিংকে সাময়িক সমাধান হিসেবে দেখা হলেও লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনাকে। কেননা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলেও ক্যাপসিটি চার্জ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পিডিবি। বরং বেশি উৎপাদন হলে বেশি বিক্রি হতো এবং এতে গড় করে উৎপাদন খরচ কিছুটা হলেও কমে আসত। পাশাপাশি সরকারের দেয়া ভর্তুকিও সামাল দেওয়া যেত।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমানে শীতকালে ৪-৫ মাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত ক্ষমতা স্ট্যান্ডবাই রাখতেই হলে তা বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর গায়ে না দিয়ে সরকারি কেন্দ্রে রাখা গেলে অলস সময়ের জন্য কোনো মূল্য পরিশোধ করতে হতো না। প্রশ্ন হলো, সরকারতো ইচ্ছা করে বড় বড় সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে হয় অচল না হয় আধা সচল করে রেখেছে। অথচ বড় বড় সরকারি কেন্দ্রগুলোকে ওভারহলিং করে সচল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল বিএনপি। কিন্তু ২০০৯ এ ক্ষমতায় এসে প্রথম এক বছর ইচ্ছা করে সরকার বিদ্যুৎ সেক্টরের উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বিদ্যুৎপরিস্থিতিকে দুর্বিষহ করে তোলে যেন বিনা টেন্ডারে অধিক ব্যয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়। যেমন, কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের মেইনটেনেন্স ও উন্নয়নে কোনো মনোযোগই দেয়নি সরকার। এর ফলে সব দিক দিয়ে ভায়াবল এই প্রজেক্টের বর্তমান অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২৪২ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এই প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে ৩৫ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। ৪টি ইউনিটের মধ্যে মাত্র একটি ইউনিট চালু আছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকারের তরফে অর্থ সংকট থাকলেও কুইক রেন্টালের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া কিংবা বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে দশগুণ বেশি দামে গ্যাস কেনার জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগ লুটেরা সরকারের অর্থের অভাব হয় না। কারণ এর একটা বিরাট অংশ যে তারাও পায় নিভৃতে, কোন টেন্ডার, মাঠপর্যায়ের কর্মযজ্ঞ ও জটিলতা ছাড়াই। বিদ্যুৎখাত এখন সরকারের দুর্নীতি ও টাকা পাচারের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘রিজার্ভের টালমাটাল অস্থিরতা, ব্যাংকিং খাতে চরম অরাজকতা ও অব্যবস্থাপনা, তীব্র জ্বালানি সংকট, ডলার ঘাটতির কারণে আমদানি ব্যয় নির্বাহের সংকট, বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে উৎপাদন ব্যহত হয়ে সম্ভাব্য রফতানি সংকট, সবমিলিয়ে অর্থনীতি এক মহাসংকটে নিপতিত হয়েছে।’
ফখরুল বলেন, ‘সংকটকালে যেখানে দরকার ছিল প্রশাসন পরিচালন ব্যয়ে লাগাম টানা, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অপব্যয় বন্ধ করা, অপ্রয়োজনীয় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করা; সেটি না করে সরকার জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দিয়ে এখন জনগণের ওপর লোডশেডিং চাপিয়ে দিয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বিধায় এ অবৈধ সরকার জনকল্যাণের প্রতি কোন দায়দায়িত্বও বোধ করে না।’
বিএনপি মহাসচি বলেন, ‘বর্তমানে জ্বালানি সংকটের কথা বলে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে রাখার যে ঘোষণা দেওয়া হলো তাতে ওই কোম্পানিগুলোর বরং লাভ, কেননা কোনোরকম উৎপাদনের ঝামেলা ও ঝঞ্ঝাট ছাড়াই বসে বসে তারা ক্যাপাসিটি চার্জতো পেতেই থাকবে। অথচ এই বোঝা বহন করতে হচ্ছে জনগণকে। তাই জনগণের উচিত এখনই সোচ্চার হওয়া, বর্তমান কর্তৃত্ববাদী জবাবদিহিহীন সরকারের গুম, খুন, অমানসিক অত্যাচার, অনাচার, নিশিরাতের ভোট ডাকাতি ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার লোপাট, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এবং সাগরচুরি ও হরিলুটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সারাদেশে লোডশেডিংয়ের নামে চলছে জনভোগান্তি। শহরের চেয়ে গ্রামে এ ভোগান্তি অনেক বেশি। গ্রামে লোডশেডিং এতো বেশি লম্বা হচ্ছে যে, বিদ্যুৎ কখন থাকে এখন সেটাই যেন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি শিল্পসহ সকল উৎপাদন খাত দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে, এখন বিদ্যুতের লোডশেডিংজনিত জনদুর্ভোগ মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যুক্ত হয়েছে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। চরমভাবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সাধারণ মানুষের।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয়, রিজার্ভের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাসের দায় নিয়ে বর্তমান অবৈধ ফ্যাসিস্ট সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে দুর্বার গণআন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এ সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জাবিউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।
ওআ/