রামু ট্রাজেডির ১০ বছর : উত্তমের খোঁজ জানেন না বাবা-মা


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১০:৪৩ অপরাহ্ন, ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০২২


রামু ট্রাজেডির ১০ বছর : উত্তমের খোঁজ জানেন না বাবা-মা
এ ঘটনার ১০ বছরে এসেও সেই উত্তম বড়ুয়া

***বিচার নিয়ে হতাশ বৌদ্ধ সম্প্রদায় চান ‘শান্তি ও সম্প্রীতি’

তৌহিদুল ইসলাম, কক্সবাজার: ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে আলোচিত সম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছিল। যেদিন উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের ফেসবুক আইডিতে পবিত্র কোরআন অবমাননাকর ছবি পোষ্ট করার অভিযোগ তুলে উস্কানিমূলক মিছিল সহকারে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা চালিয়ে বিহারে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এতে কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৩ টি বৌদ্ধ বিহার এবং ৩০ টি বসত বাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ঘটনার ১০ বছরে এসেও সেই উত্তম বড়ুয়ার কোন খোঁজ জানেন না তার বাবা ও মা। এমন কি উত্তম বড়ুয়ার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে এখন কোথায় আছেন তার তথ্যও দিতে পারেননি কেউ।

উত্তম বড়ুয়ার বাবা সুদত্ত বড়ুয়া জানান, পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অর্থ কষ্টে চরম দুরাবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। ছেলের সাথে কোনভাবেই এ পর্যন্ত তাদের কোন যোগাযোগ হয়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছেন উত্তম বেঁচে আছেন। ঠিক কোন মাধ্যমে উত্তম বেঁচে থাকার তথ্য জেনেছেন তা প্রকাশ করেন নি তিনি। তবে সুদত্ত জানান, তার ছেলে দেশে আছে কি বিদেশ আছে তা জানেন না। প্রধানমন্ত্রী চাইলে ছেলেকে তার কাছে ফিরে আনতে পারেন। মৃত্যুর আগে ছেলেকে দেখতে চান তিনি।

উত্তমের মা মাধু বড়ুয়া জানান, ১০ বছর আগে সংঘঠিত ঘটনাটিতে উত্তম কোনভাবেই জড়িত নন। উত্তমকে ফিরে আনা হলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে। তার ছেলে ফিরে আনার দাবি মায়ের।

রামুর হাইটুপী পাড়া উত্তমের বাবা ও মায়ের সাথে আলাপ হলেও ওখানে পাওয়া যায়নি উত্তমের স্ত্রী রিতা বড়ুয়া ও ১৪ বছরের সন্তান আধিত্র বড়ুয়া। সুদত্ত বড়ুয়া ও মাধু বড়ুয়া জানান, তাদের পুত্র বধু নাতিকে নিয়ে সীমা বিহার সংলগ্ন ভাড়া বাসায় থাকেন।

ওখানে গিয়ে পাওয়া যায়নি রীতা বড়ুয়াকে। তিনি কোথায় এ তথ্যও দিতে রাজী নন কেউ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনার পর পুলিশ বাদি হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জন এবং অজ্ঞাত আরও ১৫/১৬ হাজারজনকে আসামী করে ১৮টি মামলা করে পুলিশ। পরবর্তীতে এসব মামলায় প্রায় ১ হাজারেরও বেশি  মানুষকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেয় পুলিশ। কিন্তু ১০ পার হলেও এখনো পর্যন্ত একটি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় বিচার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। তারা বলেছেন, এখন বিচারের নামে নিরাপরাধ কোন ব্যক্তি হয়রানী হোক তা চান না তারা। তারা চান শান্তি ও সম্প্রীতি।

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা কেতন বড়ুয়া জানান, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে রামুতে মিছিল, মিটিং  হয়েছে। অনেকেই চেনা গেছে। কিন্তু মামলার পরবর্তী যে প্রক্রিয়া তাতে অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেমন বাদ পড়েছে তেমনি নিরাপরাধ অনেকেই হয়রানী হতে দেখা গেছে। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির। এখন সকলেই শান্তি চান; যে সম্প্রীতিতে রামুবাসি বসবাস করছে তা যে রক্ষা হয়।

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা বিপুল বড়ুয়াও বলেছেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘ঘটনার ১০ বছরে এসে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ ভুলতে বসেছে। পুঁড়িয়ে দেয়া বিহার নান্দনিকভাবে নির্মিত করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিতে আছি; সম্প্রীতিতে আছি। এর চেয়ে বেশি পাওয়ার নেই।”

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রিয় সীমা বিহারের আবাসিক ভিক্ষুক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরী হয়েছিল তা অনেকটা ঘুছিয়েছে। এটা ধারাবাহিক রক্ষা করা জরুরী। বিচারের নামে প্রকৃত অপরাধিদের চিহ্নিত করা জরুরী। এটা করতে গিয়ে নিরাপরাধ কেউ হয়রানীতে শিকার হোক তা কোনভাবেই কাম্য নয়।

কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল ১৯ টি। এরমধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে ১৮ টি মামলা করেন। অপর একটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা করলেও পরবর্তীতে বিবাদীদের সঙ্গে আপোষনামা দিয়ে খালাস করেছেন। বিচারাধীন ১৮টি মামলায় স্বাক্ষী না পাওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা।

রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনকর্মকর্তা জানান, মামলায় কোনভাবেই স্বাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে রাজী হচ্ছে না। ফলে মামলা নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকট হচ্ছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতাও সাক্ষ্য দিতে বা হাজির হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছে না।

জেবি/ আরএইচ/