দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে জেলেদের অপহরণ করছে কারা?
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২:৩১ পূর্বাহ্ন, ২৫শে ডিসেম্বর ২০২২
একটা সময় সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে বনদস্যু আর জলদস্যুদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আতঙ্কে ছিল জেলে বাওয়ালীরা। অস্ত্রের মুখে তাদের জিম্মি করে মুক্তিপন আদায় করতো বিভিন্ন দস্যু বাহিনী। মুক্তিপন না দিলে জেলেদেরকে গুলি করে মেরে ফেলা হত।
আশির দশক থেকে শুরু হওয়া চাঁদাবাজি ও অপহরণের এই তান্ডব চলে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালে কলঙ্কিত সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। সেসময় ওই সালের ৩১ মে মাষ্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে এ অগ্রযাত্রার সূচনা হয়। এ পর্যন্ত ২৬টি বাহিনীর ২৭৪ জন সুন্দরবন অঞ্চলের জলদস্যু ও বনদস্যু অস্ত্রসহ আত্নসমর্পণ করে। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিভাবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন। তবে এর আগে ১৩৫ জন জলদস্যু ও বনদস্যু র্যাবের গুলিতে নিহত হয়। র্যাবের ক্রমাগত সাঁড়াশি অভিযানে দস্যুরা ফেরারি জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ খুঁজতে থাকেন।
এদিকে দীর্ঘ কয়েক বছর পর আবার মাথা জাগিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের জেলেদের মূর্তিমান আতঙ্ক সেই দস্যুরা। প্রশ্ন উঠেছে দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে এরা কারা? গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া ও চরাপুটিয়ার বুজবুজ এলাকা থেকে একটি দস্যু বাহিনী জেলে বহরে হামলা চালিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। দস্যুদের দাবিকৃত সেই পণের টাকা দিতে না পারায় জেলেদের মাছ লুটে নেয় তারা।
এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর বনের শ্যালা নদী সংলগ্ন আলকি এলাকা থেকে ৯০ হাজার টাকা মুক্তিপণের দাবিতে তিন জেলেকে অপহরণ করে অপর একটি দস্যু বাহিনী। ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিপণের দাবিতে আট জেলেক নিয়ে দস্যুরা। তাদের হাতে সাতদিন জিম্মি থাকার পর ২০ ডিসেম্বর এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পেয়ে দস্যুরা জেলেদের ছেড়ে দেয় বলে জানা গেছে।
মুক্তিপণ দিয়ে দস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া জেলে ফারুক খাঁন বলেন, ‘আমাদের নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের (দস্যু) কাছে দুটি পাইপগ্যান, ছয়টি রামদা ও বেশকিছু লাঠি ছিল। দুটি নৌকায় আটজন দস্যু ছিল’। তাদের কাছে এখনও ৩০ থেকে ৩৫ জন জেলে জিম্মি আছেন বলেও জানান এই জেলে।
দীর্ঘদিন শান্ত সুন্দরবনে হঠাৎ দস্যুদের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠায় আতঙ্কে রয়েছেন সুন্দরবন অঞ্চলের জেলেরা। করোনা মহামারি থেকে শুরু করে বারবার সুন্দরবনের আভ্যন্তরে বন্ধ থাকায় নিরুপায় হয়ে ওঠে বননির্ভরশীল পেশাজীবিরা।
মোংলার চিলা এলাকার জেলে বিদ্যুৎ মন্ডল ও মোতাহার হোসেন বলেন, ‘বনবিভাগ থেকে কাঁকড়া ও মাছ ধরা পাশপারমিট নিয়ে জেলেরা বনের ভিতরে গেলে তাদেরকে মারপিট ও অস্ত্রের মুখে মাছ লুটপাট করে মুক্তিপণের দাবিতে দস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এ অবস্থায় কিভাবে ভিতরে ঢুকবো বুঝতি পারছিনা’।
র্যাব-৬ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, ‘র্যাব ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে গত দু’দিন ধরে আমরা এ বিষয়ে অপারেশন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। আভিযানিক দলটি এখনও সুন্দরবনের ভিতরে রয়েছে। দস্যুদের ধরে আনার পর বিস্তিরিত জানানো হবে’।
র্যাবের পদস্থ এই কর্মকর্তা আরও বলেন, অভিযানের ফলেই দস্যুরা কিছু জেলেদের ছেড়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সুন্দরবনে র্যাব এ পর্যন্ত ২২৩টি সফল অভিযানে ৫০৭ জলদস্যু ও বনদস্যু গ্রেফতার, এক হাজার ৫৫৫টি অস্ত্র এবং ৩৩ হাজার ৩২৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে।
লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, ২০১৬ সালের ৩১ মে মাষ্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ২৬টি বাহিনীর ২৭৪ জন সুন্দরবন অঞ্চলের জলদস্যু ও বনদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। এদের আর্থিক সহায়তা করাও হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মোংলা সদর দপ্তর) অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার শেখ মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হঠাৎ করে সুন্দরবনে দস্যুদের অপতৎপরতায় তাদের টহল জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া অপহৃত জেলেদের উদ্ধার এবং দস্যুদের ধরতে বনের বিভিন্ন এলাকায় র্যাবের সাথে যৌথ অভিযান চালানো হচ্ছে!
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবন এবং সাগরের জলসীমায় যেকোন অপরাধ দমনে তারা সজাগ রয়েছে। দস্যুরা কোন অপরাধ সংগঠিত করে পার পাবেনা বলেও জানান তিনি।