চুয়াডাঙ্গায় আখিঁ তারা জেনারেল হাসপাতালে সিজারের পর প্রসূতির মৃত্যু
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮:০৮ পূর্বাহ্ন, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০২৩
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল এলাকায় আখিঁ তারা জেনারেল হাসপাতালে সিজারের ৩ দিন পর মর্জিনা মিতু নামে প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) ভোরে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ফুটফুটে পুত্র সন্তানকে রেখেই পৃথিবীর থেকে বিদায় নিলেন মিতু।
মর্জিনা মিতু চুয়াডাঙ্গা শহরের পুরাতন মাদ্রাসাপাড়ার সম্রাট হোসেনের স্ত্রী।
এদিকে এঘটনা প্রসূতির এক স্বজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে কর্তব্য অবহেলার অভিযোগ তুলে বিস্তারিত ঘটনা পোস্ট করলে তারা রীতিমত ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগ তুলে শাস্তির দাবি জানান।
প্রসূতির পরিবারের সদস্যরা জানায়, গত ২৮ জানুয়ারী বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আঁখি তারা জেনারেল হাসপাতালে মর্জিনা মিতুকে ভর্তি করা হয়। পরদিন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আকলিমা খাতুন অস্ত্রপচারের মাধ্যমে পুত্র সন্তান প্রসব করান। যদিও সম্ভাব্য প্রসবের দিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
৩১ জানুয়ারি সকালে প্রসুতিকে গ্যাসটিকের ইনজেকশন দেওয়া হলে ‘বুক ফেটে গেল’ বলে চিৎকার করতে থাকেন প্রসূতি। এরপরই আঁখি তারা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে এ্যাম্বুলেন্সে করে প্রসূতিকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের পাঠানো হয়। সেখানে প্রসূতিকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। জানানো হয়, চিকিৎসক আকলিমার স্বামী (ডা. তারিখ হাসান শাহিন) কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ বড় ডাক্তার। উনার তত্ত্বাবধানে ভালো চিকিৎসা চলছে।
পরিবারের সদস্যরা আরও বলেন, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর থেকে রোগীর অবস্থা ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। স্বজনদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথাবার্তা বলা হয়। একবার জানানো হয়, রোগীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। আবার বলে রোগীর ফুসফুসে ফেটে গেছে। আরেকবার বলেন, রোগীর হার্টের অবস্থা ভালো নয়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রসূতিকে ঢাকা কিংবা রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নিতে চাইলে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, রোগীকে নিয়ে গেলে ৭/৮ ঘন্টা যাত্রার পথের মধ্যে রোগীর জীবনের ঝুকি থাকতে পারে। আবার জানানো হয়, এখানে তো চিকিৎসা হচ্ছে। এ অবস্থায় এ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া যাবে না।
১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বেধে যাচ্ছে। তাঁকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকা/রাজশাহীতে নেওয়া যাবে না। বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে প্রসূতি মর্জিনা মিতু পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রোগীর করুণ মুত্যু হয়। বিয়ের এক বছর পূর্তির পরই সন্তান প্রসব করেন মর্জিনা মিতু। এর তিন দিনের মাথায় সন্তানের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন মা।
এদিকে এঘটনার বর্ণনা তুলে ধরে মিতুর এক স্বজন সাংবাদিক বাবলু রহমান তার নিজস্ব ফেসবুকে আইডিতে পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকে ভুল চিকিৎসা ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ তুলে মন্তব্য করতে দেখা যায়।
কনিকা বিশ্বাস নামে এক নারী মন্তব্যের ঘরে লেখেন, 'আহারে কি হতে কি হলো। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। জড়িত ডাঃ দের (চিকিৎসক) আইনের আওতায় আনা উচিত।
জ্যোৎস্না বেগম নামে একজন লিখেছেন, "আহারে, হৃদয় বিদারক এ মৃত্যু। ভুল চিকিৎসার কারণে অকালে একটা সুন্দর জীবন ঝরে গেলো। সমবেদনা রইলো পরিবারের প্রতি। এভাবেই ভুল চিকিৎসায় বহু মানুষ প্রায়ই মরছেন। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর হলো স্বাস্থ্য দপ্তর, এখানে এসব ডাক্তারদের বাড়বাড়ন্ত। সরকার অবশ্যই নজর দিন এই ভুল চিকিৎসা রোধে, না হয় ভবিষ্যতে আরও বহু জীবন ঝরে যাবে।
মানস পাল সৈকত প্রকাশন নামে একজন লিখেছেন, "বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে এই মৃত্যুর কারণ চিকিৎসার ভুল বা গাফিলতি। আইনের আশ্রয় নেয়া উচিত।
এছাড়াও অনেকে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগ তুলে শাস্তির দাবি জানান।
এ বিষয়ে জানতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আকলিমা খাতুন, তার স্বামী কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক (সার্জারী) ডা. তারিক হাসান শাহীন, আখি তারা জেনারেল হাসপাতালের মালিক ডা. তরিকুলের নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলে তারা রিসিভ করেননি।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টম্বর আঁখি তারা জেনারেল হাসপাতালে আমেনা খাতুন নামের এক নারীকে অস্ত্রপচার (সিজার) করা হয়। ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তড়িঘড়ি করে অচেতন অবস্থায় আমেনা খাতুনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে আঁখি তারা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমেনা খাতুনের অচেতন দেহ নিয়ে রাজশাহী যাওয়ার সময় পথের মধ্যে নাটোরের লালপুরে পৌঁছালে পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ হয়।
তখন তাঁরা সেখানকার একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় আখি তারা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কর্তব্য অবহেলার অভিযোগ তোলেন ওই প্রসূতির পরিবারের সদস্যরা। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হলে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জাহানের নেতৃত্বে এবং চুয়াডাঙ্গা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিনিধি ডা. আওলিয়ার রহমানের উপস্থিতিতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়।
এ সময় প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা প্রদানের বৈধতা না থাকা ও ১০টি ত্রুটি পাওয়ায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৫৩ ধারায় ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক ডা. তরিকুল ইসলামকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে ক্লিনিকটির চিকিৎসা প্রদানের বৈধতা রয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানা গেছে।
আরএক্স/