মধ্য রাতে বসে পানের হাট, আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা


Janobani

উপজেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:০২ পূর্বাহ্ন, ১০ই এপ্রিল ২০২৩


মধ্য রাতে বসে পানের হাট, আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা
পানের হাট

মাথার উপর না আছে কোন ছাউনী। নেই নিদৃষ্ট কোন বসার জায়গা। স্থায়ী দোকানিদের নিরাপত্তার খাতিরে জ্বালিয়ে রাখা বিজলী বাতির আলোই যাদের সম্বল। জোঁনাকী পোকার মত জ্বলছে শত শত টর্চ আর মোবাইলের আলো। 


আলো আঁধারের মধ্যে গভীর রাতে হাজার হাজার মানুষের ভীড়। নছিমন, করিমন আর আলম সাধুর মত যন্ত্র দানবের বিকট শব্দে ছুটে চলার মাঝে নির্ঘুম রাতের সারথী এক ঝাঁক মুটে-মজুরের ক্লান্তিহীন ছুটে চলার দৃশ্যটা বলে দিচ্ছে এটি হাট। 


মধ্যরাতে এমন দৃশ্যের শত বছরের স্বাক্ষি খুলনার বৃহত্তর বাণিজ্যিক কেন্দ্র কপিলমুনি। যেখানে গভীর রাতে বসে পানের হাট। বছরের হিসেবে কেনা-বেচায় ইতোমধ্যে কোটি টাকার সেঞ্চুরীটাও হয়েছে। তবুও নিতান্তই অবহেলা আর অনাদরের মাঝে শত কোটি টাকার কেনা-বেচার দাবিদার পানের হাটের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলি যেন যাযাবর-উদ্বাস্ত। অভিযোগ, অনুযোগের ফাইলটি কর্মব্যস্ত মানুষগুলির শরীরের লোনা জলে যেন ভিজে গেছে। 


হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির বেঁধে দেওয়া “ভোর আইনের” কাছে সবই তুচ্ছ। হরিদাশকাটি গ্রামের পান চাষি আলম জানান, নিজের বরজের (পান ক্ষেত) পান নিয়ে যথারীতি মধ্যরাতে এসেছেন কপিলমুনি হাটে। ভোরের নামাজের আগেই বেচা-কেনার কাজ শেষ করতে হবে। 


কারণ হিসেবে জানান, যে জায়গায় এখন তারা পান বিক্রির করছেন সকালে এখানে অন্য মালের বেচা-কেনা হবে। বিগত ৫/৭বছর তিনি সপ্তাহে দুইদিন হাটে আসেন। এরই মধ্যে জায়গা বদল হয়েছে দুইবার। ঠাকুরদার (পিতামহ) বাবার আমলের পারিবারিক পেশা পান চাষ। 


এই মোকামে খুচরা পান বিক্রি দোকানও রয়েছে তার। কথা হল আদিত্য হোড়ের সাথে, তিনি জানান, পান চাষে নানাবিধ ঝুঁকি রয়েছে। বৈরী আবহাওয়া চাষিকে নিঃস্ব করতে পারে। এমনটি হয়েছেও বহুবার কিন্তু সরকারি কোন সহযোগিতা মেলেনি। কৃষি বিভাগের কোন তদারকিও নেই। তবুও বাবা-ঠাকুরদাদের পেশাটাকে আকড়ে আছি।


উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, এই উপজেলাতেই এক হাজারের অধিক কৃষক রয়েছে। পান চাষকে লাভজনক করতে এবং দেশ ও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতা করতে হলেও এই মুহুর্তে পান চাষিদের প্রযুক্তি সহযোগিতা ও ব্যাটোরিয়ামুক্ত পান রপ্তানির জন্য কারিগরি সহায়তা খুবই প্রয়োজন। 


আধুনিক পান চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করে দেশে পান উৎপাদন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পান চাষি ও সম্প্রসারন কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে পানের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে


জানা গেছে, বর্তমানে হাটে পাইকারী পান বিক্রি হচ্ছে পোন (৮০ পিচ) প্রতি ১৫০ থেকে ৩০০টাকা পর্যন্ত। এখন পানের বাজার মূল্যে কৃষক মোটামুটি লাভবান হচ্ছেন। তবে আষাঢ় মাসে পানের উৎপাদন বৃদ্ধি হলে দামটা কম থাকে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। 


স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, বৈধ ও অবৈধ পথে ভারত থেকে পান আসা বন্ধ হলে কৃষক সহ সংশ্লিষ্ট সকলে উপকৃত হবে। করোনাকালীন সময়ে পান রপ্তানীতে ভাটা পড়েছে। দ্রæত সমাধান হওয়া দরকার। 


তবে পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় দক্ষিনাঞ্চলের সুস্বাদু পান রাজধানীসহ চট্টগ্রাম, সিলেট, কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নতুন নুতন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পান চাষ ও ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত দক্ষিন খুলনা ও সাতক্ষীরার প্রায় ৭/৮লাখ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।


কপিলমুনি হাটের ইজাহা গ্রহিতা শেখ সোহাগ জানান, এই হাট হতে সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ আসে পান হাট থেকে। প্রতি হাটে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার পান কেনা-বেচা হয়। জায়গার স্বল্পতা আর কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে সীমাহীন কষ্ট পোহাতে হয়। হাটের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারলে বেচা-কেনা বাড়বে এবং সরকার দ্বিগুন রাজস্ব আয় করতে পারবে।


কপিলমুনি বনিক সমিতির সদস্য সচিব আব্দুর রাজ্জাক রাজু জানান, স্থান সংকুলানের অভাবে মধ্যরাতে পানের হাট বসছে। দক্ষিনাঞ্চলে সর্ববৃহৎ পানের হাটে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টিতে একটি স্থায়ী সেড নির্মান প্রয়োজন। সরকারি সহায়তা পেলে এখান থেকে সরাসরি বিদেশে পান রপ্তানী করা গেলে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। 


এদিকে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তিহীন ছুটে চলা মানুষগুলি ততক্ষনে তথাকথিত “ভোর আইনের” আওতায় আটকে গেছে। মসজিদে মোয়াজিন মাইকে জানান দিচ্ছেন আসসালাতু খইরুম মিনাননাউম। মুসল্লীরা ছুটছেন মসজিদ পানে আর নিজ ঘরে পরবাসি পান হাটের মানুষগুলি জায়গা ছাড়তে ব্যস্ত। আলো আঁধারের তিলে তিলে গড়ে ওঠা বৃহৎ এই সম্ভাবনাময় পান হাটের পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূন ভ‚মিকা রাখবে এমনটি দাবী স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।