‘জয় বাংলা’


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


‘জয় বাংলা’

আমার মুখের বুলি অন্য কারো মত জন্মগতভাবে পাওয়া নয়, আমার এই বুলি কিনেছি রক্ত দিয়ে। রক্ত দিয়ে সোনার বাংলা কেনার অনেক আগেই কিনেছি আমার এই সোনার মুখের বুলি। আমার বাংলা! আমার প্রাণের বাংলা ভাষা! এজন্যই আমার রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে শুনলে ‘জয় বাংলা’!

আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি। বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক চেতনার এক মহান প্রেরণার দিন। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই মূলত বাঙালি জাতিসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। কাজেই, বাঙালি জাতির সাথে একুশ অন্তরঙ্গভাবে জড়িত। বাংলা মায়ের মুখের ভাষার তাৎপর্য অক্ষুণ্ন রাখার স্মৃতি বিজড়িত এই মহান দিনটি বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এই মহান দিনটিকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তায় যে চেতনার জন্ম হয়েছিল তা আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসের ধারাকে আরও নিরন্তর গতিময়, প্রাণবন্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। 

এক নজর পলক ফেলে আসি এই ঐতিহাসিক দিনের সূচনালগ্ন
আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন হয়েছিল ১৯৫২ সালে। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছিল মূলত ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থেকেই। ১৯৪৭ সালে  ব্রিটিশ শাসনামলের পতনের মধ্য দিয়ে যখন কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে ঠিক তখনই এর শাসনক্ষমতা দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীরা। তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। আর মাত্র শতকরা ৭ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি সেই শাসকগোষ্ঠীরা। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করে তৎকালীন স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার। তার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলার সূর্যসন্তানেরা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অগ্রসরমান হতে থাকে পুঞ্জীভূত সেই বিক্ষোভ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শুরু হয় তীব্র গণ-আন্দোলন। সেই আন্দোলনে পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। তাতে শহিদ হন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকসহ নাম না-জানা আরও অনেক ছাত্র ও পেশাজীবী মানুষরা। শহিদের তাজা রক্তের প্রেরণায় সে আন্দোলন আরও দুর্বার হয়ে উঠে। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাধ্য হয় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশের প্রথম সফল গণঅভ্যুত্থান এবং শাসকচক্রের বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর সাহস পায় এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বলবান হয়ে উঠে। যা পরবর্তীকালে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ পরিষদের নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আদায়ের যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় । যার মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। 

বাঙালির স্বাধীনতা লাভের মূলমন্ত্র একুশের ভাষা আন্দোলনের মাঝেই নিহিত ছিল। এরই পথ ধরে আমরা আমাদের স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। ১৯৫৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে বাঙালি জাতি একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৫৩ সাল থেকে শহীদ দিবস উদযাপন করতে গিয়ে তখনকার প্রগতিশীল কর্মীরা কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্নপদে প্রভাতফেরি, শহীদদের কবরে ও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রভাতফেরিতে সমবেত কণ্ঠে একুশের গান পরিবেশন, শহীদ মিনারে আলপনা আঁকা ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এসব কর্মসূচি বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)-এর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থনে সর্বসম্মতভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশে এবং সংস্থাটির সদর দপ্তরে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বিশ্বের ১২৪ টি দেশ তা সমর্থন করে। এই সমর্থনের মধ্য দিয়ে ইউনেস্কোর ঘোষণাটি পূর্ণতা লাভ করে। যার ফলে ২১ শে ফেব্রুয়ারি  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী অধিষ্ঠিত হয়।

আজ বাঙালির একুশ যে বিশ্বজনীন দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এ গৌরব, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ত্যাগী প্রাণ থেকে শুরু করে প্রত্যেক স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রগতিপন্থি বাঙালির। কাজেই, একুশ আমাদেরকে ন্যায্য অধিকার আদায় ও মুক্তির চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছে। সেই চেতনার সারথী হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ভাষা শহিদরা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করে অমূল্য অবদান রেখেছেন। আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সেই একুশের চেতনারই ফসল। এই চেতনাকে অম্লান রেখে জাতির সকল ধরনের কল্যাণ ও অগ্রগতির পথে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার ঘটাতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে একুশের চেতনার পতাকাকে সমুন্নত রাখার জন্য। আর এ উদ্দেশ্যে, বর্তমান প্রজন্মকে যথাযথ ভাবে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবেই, একুশের চেতনায় আত্মত্যাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। আসুন গর্ব করে বলি ‘জয় বাংলা’!

লেখক: এসএ পলাশ।

এসএ/