ফুলবাড়িয়ার ভবানীপুর ফাজিল মাদ্রাসায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ম্যাজিক


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৮:২৪ অপরাহ্ন, ২০শে আগস্ট ২০২৩


ফুলবাড়িয়ার ভবানীপুর ফাজিল মাদ্রাসায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ম্যাজিক
ভবানীপুর ফাজিল মাদ্রাসা

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভবানীপুর ফাজিল মাদ্রাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে তেইশ বছর যাবত রশিদ ছাড়াই ফি আদায় করা হচ্ছে। লিজ দেওয়া অস্থাবর জমির আয়ের টাকার কোন সঠিক হিসাব নেই। মাদ্রাসার খেলার মাঠ ভাড়া দেওয়ায় খেলাধূলা বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। নেই কোন আভ্যন্তরিন অডিট কমিটি। চলছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ম্যাজিক।


উপজেলার ১৩ নম্বর ভবানীপুর ইউনিয়নে ‘ ভবানীপুর ফাজিল মাদ্রাসা’ একটি প্রাচীতম দ্বীনি প্রতিষ্ঠান বলেই স্থানীয়দের মধ্যে পরিচিত। দানভীর ও সচেতন নাগরিকরা আলোকিত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ১৯৪৪ সনে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থাবর অস্থাবর মিলে ৫.৪৯ একর জমি রয়েছে মাদ্রাসার। এর বাইরে রয়েছে প্রায় ৭২ শতক জমি। মাদ্রাসার সামনে রয়েছে সুবিশাল একটি খেলার মাঠ।


সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মাদ্রাসার প্রবেশ পথেই একটা আস্ত গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। যা মাঠে প্রবেশপথে প্রতিবন্ধকতা (ব্যরিকেট) হিসাবে কাজে লাগানো হয়েছে। কারণ মাঠটি স্থানীয় মজনু মিয়া নামের একজন বছরে দুই হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন। মাঠের ঘাস অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে না। শিক্ষার্থীরাও খেলাধূলা করতে পারে না।


কাগজে-কলমে প্রথম হতে ৫ম শ্রেণি হতে পর্যন্ত ১৩০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও ঐসব ক্লাশে কোন শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি। তারা না কি স্কুল ফিডিং না থাকায় ক্লাশে আসে না দাবী মাদ্রাসা প্রধানের।


মাদ্রাসায় প্রতিবছর সেশন ফি, পরীক্ষার ফি, রেজি: ফি, ফরম পূরণ ফি সহ নানাবিধ ফিস উত্তোলন করা হলেও তা রশিদের মাধ্যমে আদায় করা হয় না। এতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তার ইচ্ছামত খরচ দেখিয়ে মাদ্রাসায় আয়ের টাকা হাতিয়ে থাকেন। শিক্ষকদের সভায় মাদ্রাসা আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে চাইলে তাকে নানাবিধ হুমকি প্রদান করেন অধ্যক্ষ ও তার লোকজন। আভ্যন্তরীন অডিট বলতে ঐ মাদ্রাসায় কিছু নেই। ব্যাংকে সর্বশেষ কবে টাকা জমা হয়েছিল তাও জানেন না তারা। উপবৃত্তির টিউশন ফি মাদ্রাসার নামে অগ্রনী ব্যাংক ময়মনসিংহ শাখায় জমা হয়। সেই টাকা তারা তোলতে পারেন না। কারণ তাদের অনিয়মের দায়ভার অন্য কেউ নিতে চায় না।


মাদ্রাসা সংলগ্ন পশ্চিম পাশ্বের পুকুরটি লিজ দেওয়া হলেও মাদ্রাসার সামনের পুকুরটি কমিটির কোন প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই শিক্ষকরা মাছ চাষ করে সুবিধা ভোগ করছেন। আবার লিজকৃত সম্পত্তির আয়ের টাকা কিভাবে খরচ করা হচ্ছে তারও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।


প্রতি বছর কোম্পানীর বই পাঠ্য করার নামে প্রকাশনীর কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থও যায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের কব্জায়।


মাদ্রাসা থেকে দাখিল, আলিম পাশ করা শিক্ষার্থীদের মার্কসিট ও প্রত্যয়নপত্র না দিয়ে তাদের ঐ মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে বাধ্য করা হয়। শেষ পর্যন্ত যারা চলে যায়, তাদের গুণতে হয় মোটা অংকের টাকা। উপবৃত্তি সহ সরকারী বিভিন্ন সুবিধা পেতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পাওয়ার (ক্ষমতা) বেড়ে যায়। প্রত্যয়নপত্রের জন্য গেলে অভিভাবকদের সাথে খারাপ আচরণের সাথে গুণতে হয় অতিরিক্ত টাকা, না দিলে মিলে না প্রত্যয়নপত্র। 


আর এসকল আভ্যন্তরীন সকল আয়ের টাকা- মামলার খরচ, বোর্ডে যাওয়ার আসার খরচ, উপজেলা সদরে যাতায়াত খরচ ইত্যাদি অজুহাতের নামে লুটপাট করা হয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের একমাত্র সহযোগী কম্পিউটার শিক্ষক এমদাদুল হকের মাধ্যমে। শিক্ষক-কর্মচারী ও স্থানীয়রা দৃশ্যমান এ সকল অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গেলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বাহিনী দিয়ে তাদের অপমানিত ও লাঞ্চিত করা হয়।


ফাজিল পরীক্ষার্থী হালিমা খাতুনের মা রাহেলা খাতুন বলেন, আমার মেয়ে একজন প্রতিবন্ধি হওয়ার পরও উপবৃত্তি ও সরকারী সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। উপবৃত্তির আবেদনের জন্য একটা প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন হলে আমি মাদ্রাসায় গিয়েছিলাম। তিনি (ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ) আমার সাথে খারাপ আচরণ করে অতিরিক্ত টাকা দাবী করেন। রাগে আমি প্রত্যয়নপত্র আনি নাই।


স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল বলেন, মাদ্রাসায় শিক্ষার কোন পরিবেশ নাই। কী একটা হ য ব র ল অবস্থা। ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত রুমগুলোর তালাই খোলা হয় না। পুকুর, মাঠ ভাড়া দিয়ে, গাছ কেটে, সনদ বিক্রি করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সব টাকা লুটপাট করে। এলাকার কোন মানুষ সেখানে ভীড়তে দেয় না। কেউ গেলে তাকে অপমান করে। মাদ্রাসার কোন সাইনবোর্ড নাই। অধ্যক্ষের খামখেয়ালীর জন্য এই মাদ্রাসায় কোন উন্নয়ন হয়নি। তিনি বলেন আপনারা প্রতিবাদের কে? আপনাদের ফালাফালির জন্য তো কমিটি হয় না? এ ছাড়াও উপাধ্যক্ষ নিজেই অধ্যক্ষ হতে তার অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য মাদ্রাসাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।


শিক্ষকরা জানিয়েছেন আমরা মান-সম্মানের ভয়ে কিচ্ছু বলি না। অতীতে যারা বলেছে, তাদের অপমান অপদস্ত করা হয়েছে। মাদ্রাসা হট্ট্র-গলোর পেছনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের হাত রয়েছে। তিনি নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। সবার যদি চলে তাহলে আমাদেরও চলবে। আমাদের যেভাবে চালানো হবে সেভাবেই চলব।


মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোবারক আলী বলেন, প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক মামলা থাকায় আমরা উঠে দাড়াতেই পারছি না। নিয়মিত/এডহক কোন কমিটিই করা যাচ্ছে না মামলা থাকায়। আমি ২০১৪ সালে উপাধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেছি। আমি কোন রশিদ বই পাইনি। অজোপাড়াগায়ে প্রতিষ্ঠান তেমন কোন আয় নেই। ছাত্ররা ফিস ই দিতে চায় না। অন্য আয় পাব কোথায়? কিছু কিছু আয় দিয়ে মাদ্রাসার দরজা জানালা মেরামত করি।


আভ্যন্তরিক কোন অডিট কমিটি নেই। কমিটি না থাকায় ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া হয় না। যেগুলো জমা আছে সেগুলো উঠানো যায় না। গত বছর মে মাসে নবায়নের জন্য আবেদন করা হয়েছে। প্রকাশনীর সিংহভাগ টাকা পিকনিকে খরচ করা হয়েছে।


উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ফাজিল মাদ্রাসাগুলো এডিসি মহোদয় দেখেন। এত অনিয়ম খুবই দু:খজনক। প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে।


আরএক্স/