প্রথাগত বাধা পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে চুয়াডাঙ্গার রোজিনা আজ সমাজের আদর্শ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


প্রথাগত বাধা পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে চুয়াডাঙ্গার রোজিনা আজ সমাজের আদর্শ

একজন স্বামী পরিত্যক্তা নারী পরিবার এবং সমাজে তাদের প্রতি যে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা নিজেরাও নিজেদের গুরুত্বহীন বলে মনে করেন, ঠিক ভাগ্যকেও দায়ী করে থাকেন তারা। এমতাবস্থায় স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের চাহিদা মোতাবেক তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আর্থিক, সামাজিক এবং মানসিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো প্রয়োজন। অনেক বাধার কারণে তারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারে না, ঠিক নিজেকে সামনে এগোতেও অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে অনেক নারীই তাদের সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন সংগ্রাম করে আজ প্রতিষ্ঠিত। তাদেরই একজন রোজিনা খাতুন। 

২০০০ সালে সমসের আলীর সাথে ধুমধাম করে রোজিনা খাতুনের পারিবারিকভাবে বিবাহ হয়। বিয়ের পর তাদের সংসার সুখেই চলছিল। এরপর চার বছরের ব্যবধানে আছে তাদের কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে দুই কন্যা সন্তান মেয়েকে নিয়ে ভালোই কাটছিল তাদের সংসার। হঠাৎ তাদের সংসারে কলহ দেখা দেয়। নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন স্বামী সমসের আলী। নেশার টাকা আর মাঝেমধ্যে যৌতুকের দাবিতে রোজিনাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন সমসের আলী। ২০১৬ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ছোটছোট দুই মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন রোজিনা খাতুন। কারোর সাপোর্ট ছাড়াই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। কিছু টাকা জমিয়ে একটি দোকান ভাড়া নেন। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তার। বড় মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে বিবাহও দিয়েছেন। ছোট মেয়ে এখনো পড়াশোনা করছেন। 

ঠিক এমনভাবেই রোজিনা খাতুন তার সংগ্রামী জীবন তুলে ধরেছেন দৈনিক জনবাণীর নিকট। সংগ্রামী রোজীনা খাতুন চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার নুরনগর কলোনীপাড়ার বাইসাইকেল মিস্ত্রী ঈমান আলীর মেয়ে। ২০০০ সাথে পৌর এলাকার বেলগাছি গ্রামের মিয়াপাড়ার মৃত নুরুল ইসলামের ছেলের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

রোজিনা খাতুন তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দৈনিক জনবাণীকে বলেন, বিবাহ পর দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে ভালোই কাটছিল তাদের। এরপর তার স্বামী নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নেশার টাকা ও যৌতুকের দাবিতে আমার উপর চলতো মানসিক ও শারিরীক নির্যাতন। আমার বাবাকে বিষয়টি জানালে তিনি আমার সুখের কথা চিন্তা করে কিছু টাকা দেয় এবং আবার শ্বশুরবাড়িতে পাঠান। কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর নেশার টাকার জন্য  আবারো শুরু হয় নির্যাতন। বিষয়ে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে মিমাংসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটে। 

রোজিনা খাতুন বলেন, বিচ্ছেদের পর বাবার বাড়িতে ঠায় হলেও তারা আমাকে ভাল চোখে দেখতো না। আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটতে থাকে। শুরু হয় আমার সংগ্রামী জীবনের ইতি। মাস তিনেক পর চুয়াডাঙ্গা শহরের রেলবাজারে একটি টেইলার্স (দর্জির দোকানে) কাজ শুরু করি। অথচ আমি কাজের কিছুই জানতাম না। এর মাঝে সুদের উপর দুই হাজার টাকা নিয়ে বড় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করি। কিছুদিন দর্জির কাজ পর আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করি। নিজে একটি টেইলার্সের দোকান দেয়ার কথা ভাবি। দোকান মালিক জামানত হিসেবে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। আমার কাছে কোন টাকা না থাকায় চুয়াডাঙ্গা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ঝণ নিয়ে দোকানটা চালু করি। এরপর আর পিছনে ফিরতে হয়নি আমাকে। 

তিনি আরও বলেন, বিচ্ছেদের পর আমার ঠায় হয় বাবার বাড়ি। বাবা একজন বাইসাইকেল মিস্ত্রী হওয়ায় কোন রকম টেনেটুনে সংসার চলতো। তারপর আমিও আমার দুই মেয়ের থাকাতে তার অনেক কষ্ট হতো। ইচ্ছা থাকা সত্বেও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার বিবাহে অবদ্ধ হয়নি। কারোর সাপোর্ট ছাড়ায় আমি রাতভর পরিশ্রম করে দুই মেয়েকে দুই মেয়েকে পড়াশোনার খরচ বহন করছি। গত ছয় মাস পূর্বে 
বড় মেয়ে সানরিভা আক্তার শাপলাকে (১৮) ভালো পাত্র পাওয়ায় বিবাহ দিয়েছি। মেয়ে জামায় তাকে পড়াশোনা করাচ্ছে। আর ছোট মেয়ে চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। আমাকে কেউ সহযোগীতা করেনি। নিজে উপার্জন করে খেয়ে না খেয়ে দুই মেয়েকে মানুষ করেছি। 

রোজিনা খাতুন বলেন, এক কথায় সমাজের বিধবা নারীরা মর্যাদাগতভাবে প্রচুর বৈষম্য ও নানা উৎপীড়নের শিকার। তারা বিভিন্ন কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ ও অযৌক্তিক প্রথাগত বাধার সম্মুখীন। এই বাধার কারণে তারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে পারে না।
ঠিক আমারও বিচ্ছেদের পর লোকজন ও পাড়া-পড়শী আমাকে বাকা চোখে দেখতো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খারাপ মন্তব্যেরও পাত্রী হয়েছি আমি। মন খারাপ হলেও কখনো প্রতিবাদ করিনি। দুই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে দৃড় প্রতিজ্ঞা করেছি।  একজন স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই জানে জীবন সংগ্রাম কাকে বলে। আজ সকল বাধা অতিক্রম করে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আজ আমি নিজের সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করেছি এটাই আমার আনন্দ।

রোজিনা খাতুনের প্রতিবেশীরা বলেন, রোজিনা খাতুনের বাবা খুবই দরিদ্র। নেশাগ্রস্ত স্বামীর নির্যাতনের পর সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি টেইলার্স দেয়। এই থেকে চলতে থাকে তার জীবন সংগ্রাম। রোজিনা খুবই লাজুক মেয়ে। কারোর সাথে কোন উচু গলাই কথা বলেনা। পরিশ্রম করে সংসার চালিয়ে এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আর এক মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। আমরা তার এই জীবনসংগ্রামে আর্থিক সহযোগিতা করতে না পারলেও সাহস জুগিয়েছেন। রোজিনা এখন একজন ব্যবসায়ী। তার মতো সমাজের নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন তারা।

রোজিনার বাবা ঈমান আলী জানান, অর্থাভাবে মেয়েকে সাবিনাকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। তাই বাল্য বয়সে বিয়ে দিতে হয়। নিজের কোনো আয়-রোজগার নেই। নেশাগ্রস্ত ও  স্বামীর নির্যাতনের পর তাকে ভালমত জায়গাও দিতে পারেননি। কিন্তু সাহস দিয়েছেন। দুই মেয়েসহ আমাদেরও তার দেখাশোনা করছে রোজিনা।

চুয়াডাঙ্গা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর (অঃদঃ) উপপরিচালক মাকসুরা জান্নাত দৈনিক জনবাণীকে বলেন, স্বামী পরিত্যক্ত, অসচ্ছল ও অসহায় নারীদের ঘুরে দাড়ানোর জন্য সরকার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমরা তাদেরকে সব সময় সহযোগিতা করে থাকি। এছাড়াও কম সুদে তাদেরকে ঋণও দিচ্ছে সরকার।

এসএ/