স্মৃতির পাতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের শিক্ষাসফর


Janobani

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫:০০ অপরাহ্ন, ১৭ই জানুয়ারী ২০২৪


স্মৃতির পাতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের শিক্ষাসফর
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের শিক্ষাসফর। ছবি: জনবাণী

সজীবুর রহমান, জাবি প্রতিনিধি: শীতের সকালে গরম বিছানা ছেড়ে কুয়াশার আবরণ ভেদ করে ঘুম ঘুম চোখে কাঁপতে কাঁপতে চলে আসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। শিক্ষা সফর মানুষকে আত্মনির্ভরশীল হতে শেখায়, নতুন অপরিচিত মানুষদের সাথে এক আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ করে। মনের প্রকৃতি প্রেমের সুপ্ত বাতিগুলোকে জাগ্রত ও শিক্ষার আলোকে বিকশিত করতে সাহায্য করে। সৃষ্টির রহস্য, মানুষ ও প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ দর্শনের মাধ্যমে যেমন নিজেকে জানে, তেমনিভাবে বিশ্বজ্ঞানও লাভ করা যায় শিক্ষা সফরে। অজানা বিষয়গুলো সহজে আত্মস্থ হয়ে যায় এবং তা স্মৃতির পাতায় যুগের পর যুগ থেকে যায়। তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি সংগ্রহ করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সাবেক/বর্তমান সদস্য এবং সহযোগী সদস্যরা পা রাখেন  সুলতানি আমল এবং পরবর্তীতে বারো ভূঁইয়াদের আমলে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও লোকশিল্প যাদুঘর এবং মুঘল সাম্রাজ্যের আদলে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহরের ধারক-বাহক পানাম নগরীতে।


শনিবার (১৩ জানুয়ারি) সকাল সাতটায় ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয় আমাদের যাত্রা। বাস ক্যাম্পাস অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় আমাদের নাচ-গানের আসর।প্রথমেই শুরু করেন আমাদের নাঈম ভাই গাজার নৌকা পাহাড়তলী, আমার যমুনার জল, বকুল ফুল, কবিতার গান, জলের গান, রাধার কলসি জলে ভেসে যায় কোনো ধরনের গানই বাদ পরলো না, সাথে মন মাতানো নাচ। নাচানাচিতে হেমায়েতপুর পার হতে না হতেই জাবি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি-সম্পাদক ভাইয়েরা শুরু করলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের অঙ্গভঙ্গিমামুলক বক্তব্য, গঠন করলেন রাজনৈতিক দল ও দলের নেতা। শুরু হলো আরেক চমক! সবাই সাধারণ জনগণকে নিজের দলে ভেরানোর জন্য শুরু করলেন গঠনমূলক উপস্থাপনা। আমজনতা সবদিকেই তাল মেলাতে থাকেন,  দলের নেতারা পড়ে যায় বিপাকে। গাড়ির ভেতর ক্ষুদ্র অলীক জনসমাবেশে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হানুল ইসলাম মন (আইআর-৪৩), হাসান তানভীর (ইংরেজি-৪৫),  খলিলুর রহমান (জিওগ্রাফি-৪৫), নুর হাসান নাঈম (জার্নালিজম-৪৬), ইমন মাহমুদ ( ইংরেজি-৪৬),  তারা অংশ নিলেন আনন্দ মিছিলে এবং জয়ধ্বনি দিয়ে মুখরিত করলেন পুরো বাস।


আনন্দ মজা-মাস্তির পর নাস্তার জন্য চলে আসলো সকালের খাবার, খাবারে ভূনা খিচুড়ি, ডিম ভাজি ও পানি দেওয়া হলো। বাসের মধ্যেই সবাই খাবারটা শেষ করলাম। চলছে গাড়ি মহাসড়ক ধরে, সোনারগাঁওয়ের দিকে যার প্রাচীন নাম সুবর্ণগ্রাম। বাসের ভিতরে গঠন করা হলো খুত কমিটি, যাদের কাজ হলো ভজন ও সফর কেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার খুদগুলোকে খুঁজে বের করে সমালোচনা করা এবং পরবর্তীতে সংশোধন করে দেয়া।


এভাবে চলতে চলতে আমরা সোনারগাঁওয়ে পৌঁছালাম। ঠান্ডা হিমেল বাতাস বইছে কাঁপতে কাঁপতে সবাই শিক্ষাসফরের টি-শার্ট পরে নিলাম, বাস থেকে এক এক করে সবাই নেমে রওনা দিলাম লোকশিল্প যাদুঘর প্রদর্শনে।  টিকিট কাউন্টার থেকে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করা মাত্রই সবাই সারিবদ্ধভাবে ঢুকে পড়লাম লোকশিল্প যাদুঘরে। প্রবেশ করা মাত্রই ফোনের ক্যামেরাগুলো অন করতে শুরু করেছে। প্রধান ফটকের শুরুতেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের স্মৃতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, যা প্রকৃতি ও পরিবেশে গ্রামীণ রূপকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের পরিচয় বহন করে। যাদুঘরের ভেতর দেখা মিলছে পুরোনো সব প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন যেগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগ্রহশালায় দেখতে পেলাম প্রাচীন যুগের মানুষের কর্মকাণ্ড, ব্যবহার্য জিনিস, রাজা-বাদশাহদের পোশাক, প্রাচীন সুলতানদের ব্যবহৃত অস্ত্র, প্রাচীন মুদ্রা, বর্ম অলংকার ইত্যাদি। এছাড়াও লোকশিল্প জাদুঘরে আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অজানা, অচেনা কারুশিল্পীর তৈরি বাঁশ-বেত, কাঠ খোদাই, মাটি, জামদানি, নকশি কাঁথা, একতারা ও ঝিনুকের সামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র। তারপর সেই অপূর্ব সৌন্দর্য্যকে ফ্রেমবন্দী করার লক্ষ্যে সবাই ক্যামেরা হাতে ছোটাছুটি করতে থাকে। ছবি উঠানো শেষ, দলবদ্ধ হয়ে স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয়ার জন্য ক্যামেরাবন্দী হয়ে গেলাম প্রতিটি জীবন সরদার বাড়ির প্রধান ফটকে।


যাদুঘরে ফটোসেশন শেষ করেই সবাই বেরিয়ে রওনা দিলাম পানাম নগরের উদ্দেশ্য। সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর থেকে উত্তর দিকে একটু হাটলেই পানামনগর। হাটি হাটি পাঁ পাঁ করে সবাই এগিয়ে যাচ্ছি পানাম সিটি দর্শনে। নগরের নির্মানশৈলী একান্ত নিজস্বও বলা যায়। সঠিকভাবে একে পানাম স্থাপত্য কৌশল (Panam Style) বলা চলে। পানাম নগরীর নগর পরিকল্পনার মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি লেক বা খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং সুরক্ষিত গেইট দ্বারা আবদ্ধ। অনেকেই ক্ষুধায় অধীর হয়ে আছে কখন খাবার আসবে সম্মুখে? ক্ষুধার্তদের অন্ন দান করতে সম্মুখে চলে আসলো মধ্যাহ্ন ভোজের আহার সামগ্রী। পানাম সিটির নিকটবর্তী এক বিশাল মাঠে সবাই গোল হয়ে বসে পড়লাম মধ্যাহ্ন ভোজে। কেউ খাচ্ছে কেওবা কারো দিকে তাকিয়ে আছে খাবার মুখে নেয়া মাত্রই ফোনের ক্যামেরাতে একটি ক্লিক ফ্রেমবন্দী করবে এই উদ্দেশ্য। দুপুরের খাবারে বিরিয়ানির সাথে ছিল রোস্ট, ডিম, পিয়াজি, শসা, লেবু এবং এক বোতল পানি। আহার শেষ করে ভেবেছিলাম হয়তোবা দই দেয়া হবে কিন্তু দইয়ে বিকল্প হিসেবে দেয়া হলো মিষ্টি।


ভোজন শেষ  করে যাত্রা শুরু হলো সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য পানামাসিটি। সোনারগাঁওয়ে ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে ওঠে এই নগর। পানাম নগরের প্রবেশ মুখেই বিশাল একটি বই যেখানে লেখা আছে এই পানাম নগরীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করে আমরা সিটির ভেতরে প্রবেশ করলাম। ইতিহাস থেকে জানা যায়,  ঈসা খাঁর আমলে বাংলার রাজধানী ছিল এই পানাম নগর। পানাম নগরী থেকেই তখন সোনারগাঁয়ের রাজকার্য পরিচালিত হতো। পানামের পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড় এবং দেশ থেকে মসলিন কাপড় যেতো বিদেশে। বর্তমানে পানাম নগরের দু’ধারে ঔপনিবেশিক আমলের মোট ৫২টি স্থাপনা রয়েছে। এর উত্তরদিকে ৩১টি ও দক্ষিণদিকে ২১টি স্থাপনা অবস্থিত। ৪০০ বছরের পুরোনো স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে মোঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে পানাম নগরে রাস্তার দু’ধারে পুরোনো যেসব ভবন দেখা যায় তা প্রাচীন বাংলা ঐতিহ্য বহন করছে। পুরনো সব স্থাপত্য দেখতে দেখতে সবাই বিভোর হয়ে আবিষ্কার করতে থাকে বিভিন্ন রাজা-বাদশাদের প্রাচীন শাসন-আমলের ইতিহাস।  শিক্ষা সফরে এই দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করে নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে সবাই খুব উৎচ্ছাসিত। এখানেও ছবি উঠার পালা। সবাই নিজেকে ক্যামেরা বন্দী করতে ব্যাস্ত যেন ছবি উঠানোর এক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এখানে আমরা একটি গ্রুপ ছবি তুলি। প্রায় এক থেকে দুই ঘন্টা আমরা পৃথক পৃথকভাবে ঘোরাঘুরি করি ও ছবি তুলে ফিরে আসি একটা নিদিষ্ট মাঠে।


এবার খেলাধুলার পর্ব শুরু,  প্রথমেই বেলুন ফুকানোর খেলা, এই খেলায় সময় দেয়া হলো দুই মিনিট, যার বেলুন বেশি বড় হবে এবং দুই মিনিট স্থায়ী হবে সেই প্রথম পুরস্কার পাবেন, অনেকেই অল্প একটু বাতাস প্রবেশ করাতেই ফাঁটাস ফাঁটাস করে ফেঁটে গেল বেলুন। পরবর্তীতে শুরু হলো মোরগ লড়াই, সব থেকে আকর্ষণীয় খেলা ছিল সিনিয়র ভাইদের দৌঁড় প্রতিযোগিতা। খেলার শুরুতে রেফারি বাঁশি ফুঁ দেয়ার আগেই সিহাব উদ্দিন ভাই দিলেন এক ভোঁ দৌড়, দৌড়ে গন্তব্য স্থলে যাওয়ার পরে তিনি জানতে পারলেন তার দৌড় নিয়মানুযায়ী হয় নাই পরে তিনি হতাশ হয়ে ফিরে এসে আবার অংশগ্রহণ করলেন রেফারি বাঁশিতে ফুঁ দিতেই শুরু হলো আসল দৌড়। নাতুশনুতুশ শরীর নিয়ে কোনরকম ভাবে দৌড় শেষ করলেন তারা। এবার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণীর পালা, বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি-সম্পাদক মহোদয়েরা।


সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে সময় কড়া নাড়ছে দরজায় ফিরতে হবে বাসায়। এবার আমাদের ফেরার পালা, শুরু হলো ক্যাম্পাস মুখী যাত্রা। যাদুঘরে নিকটে বাস রাখা ছিল। আমাদের গন্তব্য লোকশিল্প যাদুঘরের দিকে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ঠান্ডাটাও প্রচন্ড ভাবে শরীরে প্রভাব ফেলতেছে। সবাই গাড়িতে উঠে পরলাম। বিদায়ী মুহুর্তে সবার চোখে ঘুম কিন্তু এখোনো একটা সেশন বাকি আছে। গাড়ির ভেতর একটা কুইজ সেশন হবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব থেকে প্রকাশিত "প্রত্যয়" থেকে প্রশ্ন করা হবে। নবীন সবাইকে হাতে হাতে একটি করে 'প্রত্যয়' দিয়ে পড়ার জন্য সময় দেয়া হলো। সবাই পুরস্কার পাওয়ার নিমিত্তে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়া শুরু করলাম। পড়া শেষ!  প্রকাশিত 'প্রত্যয়' থেকে ১০-১২ টি প্রশ্ন করা হলো এবং যারা সর্বোচ্চ সঠিক উত্তর দিতে পারলো তাদের মাঝে সাথে সাথে পুরস্কার বিতরণ করা হলো।


পুরস্কার বিতরণ শেষে এখন সবার অনুভূতি ব্যক্ত করার পালা। প্রথমেই প্রেসক্লাবের সহোযোগী সদস্যদের দ্বারা মনোভাব প্রকাশ শুরু হলো। তারপর সিনিয়র ভাইয়েরা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন এবং নবীনদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনামুলক বক্তব্য রাখেন। সবশেষে প্রেসক্লাবের বর্তমান সভাপতি-সম্পাদক ভাই সবাইকে শুভেচ্ছা ও শিক্ষাসফরে অংশগ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করে এই সফরের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।


বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেইট হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো অমর একুশে ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা সবাই এক এক করে নেমে পরলাম। সকল সিনিয়র ভাইদের সাথে একটি দিনেই সবাই যেনো সত্যিকারের পরিবার হয়ে গিয়েছিলাম। হাসি ঠাট্টা, নাচ গানের আসরে সবাই আনন্দে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। 


এভাবেই পরিসমাপ্তি হলো নতুন বছরে ২০২৪ সালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের স্মৃতিময় একটি শিক্ষা সফর। দিন শেষে বৃদ্ধ বয়সে বা কর্মব্যস্ত জীবনে সোনালী অতীত হয়ে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এই শিক্ষা সফর। না গেলে হয়তো অনুভব করতে পারতাম না। আমাদের এই সোনালী অধ্যায়গুলো শেষ বেলাতে অতীতের স্মৃতি যা হাজার বছর ধরে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে অ্যালবামের কোন গচ্ছিত পাতায়। 


আরএক্স/