স্বাধীনতার ৫১ বছরেও মেলেনি ওহাব আলীর শহীদ স্বীকৃতি
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও পাকসেনাদের গুলিতে নিহত যশোর শহরের ঘোপ এলাকার বাসিন্দা আব্দুল ওহাব পাননি শহীদের স্বীকৃতি। কিছু তালিকায় শহীদ হিসেবে তার নাম থাকলেও সরকারি গেজেটে না উঠায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওহাব আলীর পরিবারের সদস্যরা। শহীদ স্বীকৃতি পেতে বিভিন্ন সময় পিতা ও অন্য ভাইয়েরা দপ্তরে দপ্তরে ধর্ণা দিয়ে কাজ না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন পরিবারের সব সদস্য।
স্থানীয় সূত্র এবং মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতে ঘোপের মৃত মফিজ ঢালীর বড় ছেলে ওহাব আলীসহ সাত-আটজন ইপিআর সদস্য কারবালা এলাকায় পাক সেনাদের গুলিতে হতাহত হন। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওহাব আলীসহ কয়েকজন মারা যান। শহীদ ছেলের স্বীকৃতি পেতে অনেকের কাছে ধর্ণা দেন পিতা মফিজ ঢালী। তবে তার জীবদ্দশায় ছেলের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি না পেয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি।
তবে ২০০৬ সালের তৎকালীন জেলা প্রশাসক, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, যশোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের আহ্বায়ক নরুল ইসলাম, সদর উপজেলা ইউনিটের আহ্বায়ক বাবর আলী স্বাক্ষরিত যশোর পৌরসভার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিসেনার নির্ভুল তালিকা চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইউনিয়নওয়ারী তালিকার বইয়ের ৫৩ নম্বর তালিকায় মফিজ ঢালীর ছেলে শহীদ ওহাব আলীর নাম পাওয়া যায়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের কর্মকর্তা খন্দকার নুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত আরেক তালিকায় সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ৩২৩ নম্বরে ঘোপ জেলরোডের বাসিন্দা শহীদ ওহাব আলীর নাম দেখা যায়।
এ বিষয়ে আমেরিকা প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খুরশীদ আনোয়ার বাবলু তার ‘মুক্তিযুদ্ধ-প্রামান্যকর্ম-কথা-কবিতা-চিত্রকর্ম’ নামক বইয়ে মুক্তিযুদ্ধে ওহাব আলীর শহীদ হওয়ার করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি নিখেন, ১৯৭১ সালের পহেলা এপ্রিল। দুপুরবেলা। ওহাব আলীরা একটি পিকআপে কারবালার পাশে রেললাইনের ধারে মুক্তিযোদ্ধা বাঙালী পুলিশ, ইপিআর ক্যাম্পে খাবার ও গোলাবারুদ পৌছে দিতে যায়। তাদের কাছাকাছি পৌছালে পাকসেনাদের কামানের গোলায় ওহাব আলী, আতিয়ার, জামাল, কামালরা হতাহত হন।
ওহাব আলীর ছোট ভাই সাহেব আলী বলেন, তার পিতার কাছ থেকে বড় ভাইয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও শহীদ হওয়ার গল্প শুনেছেন। ঘটনার দিনদুপুরে ইপিআর সদস্যদের সাথে তার ভাই গোলাবারুদ আনা নেওয়ার কাজ করছিল। এ সময় আচমকা পাকসেনাদের এক গোলা এসে পড়ে তাদের অবস্থানে। ঘটনাস্থালেই মারা যান অনেকেই। গুরুতর আহত হয়ে ফাতেমা হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ওহাব আলী। খবর শুনে পিতা মফিজ ঢালীসহ প্রতিবেশী আমির আলী, কালাম, সালাম ও আলী মিয়া হাসপাতালে ছুটে যান। এরপর বাড়ির পাশে শহীদ ভাইয়ের কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে অবস্থা বেগতিক হওয়ায় প্রাণভয়ে কবর দিয়েই পালিয়ে যান সবাই। পরে সন্ধায় তার পিতা ছেলের কবর দেন। তবে সেই কবর সংরক্ষণ না করায় বর্তমানে সেখানে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে। ভাইয়ের শহীদ স্বীকৃতি পেতে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ও ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানান তারা।
ওহাব আলীর আরেক ভাই আশরাফ আলী জানান, মাত্র ১৭ বছর বয়সে অবিবাহিত থাকা অবস্থায় দেশের জন্য প্রাণ হারান তার বড় ভাই ওহাব আলী। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ পরিবারকে দু’হাজার টাকা ও একটি সনদ প্রদান করেন। তবে সে সনদটি হারিয়ে যায়। বর্তমানে তাদের কোনো আর্থিক সুবিধা বা অন্যকোনো চাহিদা নেই। শুধুমাত্র এক অকুতোভয় দেশপ্রেমিক শহীদ ভাইয়ের সরকারি স্বীকৃতি চান তারা। তার বড় ভাই তাদের পরিবারের গৌরব। এ ব্যাপারে যশোরের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মুজিব বাহিনীর নেতারা ওহাব আলীর শহীদ হওয়ার বিষয়টি জানলেও কেউ কার্যকারী ব্যবস্থা নেননি।
তবে অন্য একটি সূত্র জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় দ্বিধাবিভক্ত ছাত্রলীগেরর মধ্যে রতন গ্রুপের সাথে ওহাব আলীর সখ্যতা ছিল। দেশ স্বাধীনের পর প্রতিপক্ষের হাতে রতন নিহত হলে ওহাব আলীকে মেনে নিতে পারেননি প্রতিপক্ষ গ্রুপ। এ কারণে তাকে শহীদের মর্যাদাদানে কেউ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি।
শহীদ ওহাব আলীর পরিবারের একটাই দাবি, তাদের উত্তরাধীকার বংশধররা যেন জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধে তাদের পূর্বপুরুষের অবদান। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলায় নির্মমভাবে নিহত হওয়া শহীদ স্বীকৃতি চান তারা। একইসাথে সরকারিভাবে শহীদ ওহাব আলীর কবরের সংরক্ষণের দাবি জানান তার ভাইয়েরা।
এসএ/