চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির রাম রাজত্ব!
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫:১৮ অপরাহ্ন, ১৯শে আগস্ট ২০২৪
চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যম কায়েম করেছে রাম রাজত্ব। তার কাছে সব অনিয়মই নিয়ম, নিয়ম নীতির ধার না ধরে নিজের ইচ্ছে মত চালাচ্ছে ওয়াসাকে। তার বির্তকিত কর্মকান্ডের কারণে সংশ্লিষ্ঠ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বিব্রত। সরকার পতনের পরও তিনি আছেন এখনো বহাল তবিয়তে। ৮২ বছর বয়সি এই এমডি প্রকৌশলী এ.কে.এম. ফজলুল্লাহ। ১৯৯৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জুলাই মাসে বাগিয়ে নেন ওয়াসার চেয়ারম্যান পদ। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ড গঠনের পর চেয়ারম্যান পদের চেয়ে ক্ষমতাশালী করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদকে। তাই চেয়ারম্যান পদ বাদ দিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেই আসীন হন ফজলুল্লাহ। সেই থেকে বর্তমান পর্যন্ত আট দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ বছর ধরে স্বপদে বহাল রয়েছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন অনিয়ম, দুর্নীতির এক বিশাল রাজত্ব।
আরও পড়ুন: পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার ক্রাইসিস দুর করা হবে: পার্বত্য বিষয়ক উপদেষ্টা
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ওয়াসার যেসব প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে, সেসব প্রকল্পের নথি কৌশলে পুড়িয়ে ফেলেছেন তিনি। ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভোররাতে ওয়াসা ভবনের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি সাজানো নাটক ছিল বলে দাবি করেছেন ওয়াসা এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ওয়াসা এমডির বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিষয়ে উচ্চ আদালত তদন্তের নির্দেশ দিল। এরই মধ্যে ভবনের একটি কক্ষে রহস্যজনকভাবে আগুন লাগল এবং গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পুড়ে গেল?’ ২০২০ সালের আগুনের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল পুড়ে যাওয়াকে যেমন ‘রহস্যজনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, তেমনি ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ফাইল সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে এই এমডির বিরুদ্ধে।
যদিও এমডি ফাইল সরানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এই এমডির হাত ধরেই ওয়াসায় এখন চলমান আছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিকাদার, উপ-ঠিকাদার, প্রকল্প পরিচালক এবং ওয়াসার কর্মীদের মধ্যে কৌশলে অর্থ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। কাগজপত্রে ওয়াসার বড় পাঁচটি প্রকল্পের কাজ পেয়েছে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার পর কৌশলে ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উপ-ঠিকাদার হিসেবে কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবান নেতারা। এসব ক্ষমতাবান নেতা নিজেদের পকেট ভারী করতে ওয়াসা এমডিকে সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ‘সিংহাসন’ টিকিয়ে রেখেছেন মহারাজ।
অভিযোগ উঠেছে, এমডির অপরাধকর্মের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন, প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম, নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুব আলম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল আমিন, অর্থ বিভাগের আল মেহেদী শওকত আজম, এমডির ভাগ্নি লুৎফিজাহার ও তার স্বামী শফিকুল বাশার, কার্য সহকারী রেজাউল হোসেন দুলাল, উচ্চমান সহকারী খোরশেদ আলম, ইলেক্ট্রশিয়ান রুহুল আমিন, ওয়াসার সাবেক গাড়িচালক তাজুল ইসলাম এবং এমডির বর্তমান গাড়িচালক মোহাম্মদ ইসকান্দর। এদের মধ্যে শেষোক্ত পাঁচজন ওয়াসায় বদলি বাণিজ্যে এমডির সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ওয়াসার অধীনে ছোট প্রকল্প ছাড়া বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে পাঁচটি। বর্তমানে চলমান আছে দুটি। সব মিলিয়ে উন্নয়ন কাজ হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার।
আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলন: চট্টগ্রামে সংঘর্ষে নিহত ৩
অতীতে চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমন একজন সদস্য সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, ওয়াসা এমডির সহযোগিতায় বড় প্রকল্পের উপ-ঠিকাদার সেজে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আমি বোর্ড সভায় নানা ধরনের অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু অর্থলিপ্সুদের কাছে আমার প্রতিবাদী কণ্ঠ হয়ে যেত ম্রিয়মাণ।’ ওয়াসা বোর্ডের সাবেক এই সদস্য আরও বলেন, রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে অনিয়মের নানা প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। কিন্তু সেসব অনিয়ম সমাধানে এমডির আগ্রহ দেখা যায় না।
কী জাদুবলে প্রকৌশলী এ.কে.এম. ফজলুল্লাহ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আট দফা নিজের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ প্রকাশ্যে দিতে রাজি হননি। তবে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘স্যার ‘সবকিছু ম্যানেজ করতে পারেন। এজন্যই এখনও স্বপদে বহাল আছেন। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। উচ্চ আদালত দুর্নীতি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি তদন্তের ওই আদেশ উচ্চ আদালতের বারান্দা পর্যন্তই সীমিত। দুর্নীতি দমন কমিশন অজ্ঞাত কারণে অভিযোগ তদন্ত করে উচ্চ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেনি।
অথচ, গণশুনানিকালে এমডি নিজেই ওয়াসায় দুর্নীতি থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছিলেন।’
ওয়াসার এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে একটি পক্ষের বিরোধ ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম ওয়াসায় এমন বিরোধ নেই। ফলে ৫ আগস্ট সরকারপ্রধান পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরও আমাদের এমডি স্যার নিয়মিত অফিস করছেন।’ বিরোধ না থাকার বিষয়ে যুক্তি দিয়ে তিনি পুনরায় বলেন, ‘এখানে এমডি স্যার সবাইকে ম্যানেজ করে চলছেন।’
১৫ বছরের রাজত্বকালে ফজলুল্লাহ ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। ২০২২ সালে ঢাকা ওয়াসার তাকসিম এ খানের মতো ফজলুল্লাহও নিজের বেতন ১৫০ শতাংশ বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। অর্থাৎ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেতন ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বেতন বৃদ্ধির আবেদন বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর সমালোচনা শুরু হলে তিনি সেই আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে ২ জনের মৃত্যু
স্বজনপ্রীতির অনেক অভিযোগও রয়েছে প্রকৌশলী ফজলুল্লাহর বিরেুদ্ধ। চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রোগ্রামার লুৎফি জাহান হলেন এমডির ভাগ্নি। আর লুৎফির স্বামী সিস্টেম এনালিস্ট শফিকুল বাশার। তারা স্বামী-স্ত্রী এমডির নিকটাত্মীয় হওয়ায় অন্যদের তোয়াক্কা করেন না। শফিকুল বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ওয়াসার জন্য মিটার ক্রয়ের নামে নিম্নমানের মিটার ক্রয় করে এমডির যোগসাজশে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর এই দম্পতি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ গমনের ইচ্ছা পোষণ করে বহির্বাংলাদেশ ছুটির আবেদন করেছেন। যা এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ভাগ্নি ও ভাগ্নি জামাইয়ের অনিয়ম ও দাপটের সঙ্গে যোগ দেন এমডির মেয়ে সুমাইয়া বিনতে ফজলুল্লাহ। তাকে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার সুয়ারেজ প্রকল্পের কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও আপন ভাগিনা সারোয়ার জাহান ওয়াসার ঠিকাদার হলেও সারা দিনই ওয়াসা ভবনে ঘুরে ঘুরে কর্মকর্তাদের কাজের তদারকি এবং তদবির করেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম ওয়াসা গিয়েও দেখা যায় এমডি একেএম ফজলুল্লাহকে।
তবে ওয়াসা কার্যালয়ে দীর্ঘদিন পদবঞ্চিত এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানাভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি অনিয়মের কথাও তারা তুলে ধরেছেন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানিয়েছেন, ওয়াসার এমডি আধিপত্য বিস্তার করে জ্যৈষ্ঠতা ভেঙে পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রকল্পের পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব দিয়েছেন।
বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী এ.কে.এম. ফজলুল্লাহর কার্যালয়ে গত এক সাপ্তাহে ধরে বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি মিডিয়াকে কোন বক্তব্য দিচ্ছে না এবং তার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করলেও রিসিভ করছে না।
এসডি/