খাদ্যসংকটে ধুঁকছে বানর, দর্শনার্থীই ভরসা; পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয় বলছে বন কর্মকর্তারা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


খাদ্যসংকটে ধুঁকছে বানর, দর্শনার্থীই ভরসা; পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয় বলছে বন কর্মকর্তারা

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় সন্তোষপুর বিটে খাদ্যসংকটে ধুঁকছে বানর, বনাঞ্চলে ফলের গাছ না থাকায় খাবারের খোঁজে দর্শনার্থীদের কাছে ভিড় করে বানরগুলো। দর্শনার্থীই বানরগুলোর বেঁচে থাকার একাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে।

ফুলবাড়িয়ার সন্তোষপুর বনের বিট কর্মকর্তা মো. রউফ মিঞা বলেন, ‘২ হাজার ২৭৭ একর জায়গাজুড়ে শালবনের সব জায়গায় বানর ঘোরাফেরা করে না৷ বিট অফিসের আশপাশের গাছগুলোতে বেশি থাকে, কারণ এদিক দিয়েই বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা প্রবেশ করেন।

ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুর বনাঞ্চলে এখন বানরের সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। কিন্তু বনে নেই খাদ্যের জোগান। তাদের জন্য বন বিভাগ কিছু ফলের গাছ লাগালেও এখন সেগুলো নেই। তাই খাদ্যের সংকটে ধুঁকছে বানরগুলো। বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরাই এখন তাদের ক্ষুধা মেটাতে অন্যতম উৎস।

বন কর্মকর্তাদের দাবি, নিয়মিত পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করছেন তারা কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই বনাঞ্চলে হরিণ, ভাল্লুক, মেছোবাঘ, বাঘডাশা, শিয়াল, খরগোশ ও বানরসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণ ছিল। কিন্তু বনদস্যুরা অবাধে গাছ কাটায় বানর ব্যতীত হারিয়ে যায় অন্য সব বন্য প্রাণী। অন্তত ২৫ বছর ধরে অন্য প্রাণীদের সেখানে দেখা যাচ্ছে না।

এরই মধ্যে বানরগুলোও পড়েছে খাদ্যসংকটে। খাবারের খোঁজে মাঝেমধ্যেই তারা বনাঞ্চল ছেড়ে চলে আসে লোকালয়ে। তাই সরকারিভাবে তদারকি বাড়ানো না হলে বানরগুলোও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বনাঞ্চলের ভেতরে বিট অফিসের কাছেই ছয়টি ভ্রাম্যমাণ দোকান। এসব দোকানের আশপাশে দলবেঁধে বানরগুলো খাবারের খোঁজ করছে৷ কয়েকটি বানর আবার গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে আর দর্শনার্থীদের দেখামাত্র ছুটে বন থেকে বেরিয়ে আসছে।

অনেক দর্শনার্থী দোকান থেকে কলা, মুড়ি, বাদাম, চানাচুর, বিস্কুটসহ নানা ধরনের খাবার কিনে বানরগুলোকে দিচ্ছেন। ক্ষুধার্ত বানরগুলো দর্শনার্থীদের মাথা ও কাঁধে উঠে খাবার নিয়ে যাচ্ছে।

বানরগুলোকে বাদাম দেয়ার সময় কথা হয় ইয়াকুব আলী নামে এক দর্শনার্থীর সঙ্গে। তিনি বলেন, চৌদার থেকে দুই বন্ধু কাজে ফুলবাড়িয়া বাজারে এসেছিলাম। এ সুযোগে এখানে ঘুরতে আসলাম। বনাঞ্চলের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে এসব বানর। আমার হাত থেকে খাবার নেয় কিন্তু কামড় বা আঁচড় দেয় না। দেখে মনে হয় খাদ্যের অভাবে ধুঁকছে এগুলো।’

দর্শনার্থী ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘ময়মনসিংহের চরপাড়া এলাকা থেকে সপরিবারে এসেছি। ভাঙ্গাচোরা সড়ক দিয়ে আসতে কিছুটা বিড়ম্বনা হলেও বনাঞ্চলে বানরের হইচই দেখে ভালো লাগছে।’

স্থানীয় এক ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ  জানান, বন বিভাগ বানরগুলোর তদারকি করে। এদের খাবারের জন্যও আলাদা বরাদ্দ রয়েছে, তবে তা দৃশ্যমান না। খাবার সীমিত হওয়ায় বাড়তি খাদ্যের জন্য বিভিন্ন দিকে ছুটে বেড়ায় বানরগুলো।বন বিভাগের মাধ্যমে দায়সারা বানরের খাদ্য বিতরণ করছে এটা বোঝা যায়।লোক দেখানো বানরের খাবার বিতরণ। 

ফলের গাছ না থাকায় খাবার জোটে খুবই কম, দর্শনার্থী এক দিন না আসলে কষ্টে দিন কাটে এদের। এ কারণে দর্শনার্থী দেখলে খাবারের আশায় বন থেকে দল বেঁধে ছুটে আসে। বনের বানর কাউকে কামড় না দেয়ায় এরা ‘সামাজিক বানর’ হিসেবে পরিচিত।

তিনি আরও জানান, বন কর্মকর্তারা বানরদের জন্য কিছু ফলের গাছ লাগিয়েছিল। তবে সেগুলো এখন আর নেই। পাশে ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক জায়গাজুড়ে আনারসের চাষ হলেও সেখানে বানর গেলেই তাড়িয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে খাদ্যের অভাবে অনেক বানর রোগাক্রান্ত হয়েছে। অনেক বানর আবার ক্ষুধায় লোকালয়ে ছুটে যায়, তখন মানুষ এদের লাঠি, দা দিয়ে আঘাত করে। বন বিভাগ থেকে খাদ্যের পর্যাপ্ত জোগান দিতে না পারলে বানরগুলোর স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে।

সমাজ সেবক মোফাজ্জল হোসেন বলেন,অত্র এলাকার একাধিক প্রভাবশালীরা বনের হাজার হাজার একর জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়। সেই জমিতে আনারস ও ফলের বাগান করা হয়। সেই বাগানে বানর গেলে বানরকে তারা তাড়িয়ে দেয়। সরকারী শাল বন রয়েছে ২ হাজার ২৭৭ একর জায়গাজুড়ে শালবনের সব জায়গায় বানর চলাফেরা করে প্রায় চার এর শতাংশ জমি  ভূমিদস্যুদের দখলে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অত্র ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আক্ষেপ করে বলেন, বন এলাকায় ভূমিদস্যুদের অবৈধ সম্পত্তি থেকে সরাতে পারলে সেখানে বিভিন্ন ফলের গাছ হবে তাহলে বানরের খাবার অভাব পড়বে না ইনশাআল্লাহ।বর্তমানে এ বনে সরকার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে লাভবান হচ্ছে প্রভাবশালীরা।  

বন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ দোকানদার হানিফ মিয়া বলেন, ‘বানরগুলো আছে দেখেই পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারছি। দর্শনার্থীরাই এদের ভরসা। প্রতিদিন বাদামসহ বিভিন্ন খাদ্য বেচে ৪০০/৫০০ টাকার মতো লাভ থাকে। বানরগুলো বনাঞ্চল ছেড়ে চলে গেলে আমাদেরও চলে যেতে হবে।’

এ বিষয়ে সন্তোষপুর বনের বিট কর্মকর্তা মো. রউফ মিঞা  বলেন, ‘২ হাজার ২৭৭ একর জায়গাজুড়ে শালবনের সব জায়গায় বানর ঘোরাফেরা করে না৷ বিট অফিসের আশপাশের গাছগুলোতে বেশি থাকে, কারণ এদিক দিয়েই দর্শনার্থীরা প্রবেশ করেন।’

তিনি বলেন, ১নং নাওগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভিজিএফ ও ভিজিডির চাল দেয়ার সময় বানরের খাবারের জন্য কিছু দেয়া হয়, সেগুলোই বানরদের খেতে দিই। আমরাও চাল কিনে সারা বছরই বানরদের দিচ্ছি। পানি খাওয়ার জন্য হাউস করে দিয়েছি। চাল ছাড়াও এরা ফল পছন্দ করে। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের ফলের চারা লাগানোর পরিকল্পনা চলছে।

সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে ভিজিএফ ভিজিডির চাউল বিতরণের সময় বানরের জন্য আলাদা করে চাউল রেখে দিতাম। সেই চাউল শেষ হয়ে গেলে বাজার থেকে নিম্নমানের চাউল কিনে বানরকে খাবার দিতাম। বানরকে খাবার না দিতে পারলে আমার অনেক কষ্ট হতো। 

এসএ/