প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের চাপে দিশেহারা এতিম ৩ শিশু
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৫৩ অপরাহ্ন, ২০শে অক্টোবর ২০২৪
মা বাবা হারানো এতিম তিন ভাই বোনের নির্মম ব্যাথা ভরা জীবনে নেমে এসেছে ব্যাংক ঋণের বোঝা, বলছিলাম গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার মহেষপুর ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের মৃত বদরুল আলম বরকত ও তার স্ত্রী মৃত লুপা বেগম দম্পতির তিন সন্তানের কথা।
একদিকে মা বাবা হারানোর শোক আর্তনাদ। অন্যদিকে ব্যাংক লোন পরিশোধের চাপ তাড়া করছে অবুঝ এতিম তিন শিশুকে। তাদের জীবন এখন অসহায়ত্বের করুন বিষাদে ভরা।
জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক গোপালগঞ্জ শাখা থেকে দুই লক্ষ টাকা লোন নিয়ে। অভাবের সংসারে সুখের আলো জ্বালাতে ২০১৯ সালে মিম ও জিমের বাবা বিদেশে পাড়ি জমান। স্ত্রী ও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে অমানবিক পরিশ্রম করে প্রবাসে দিন পার করছিলেন বদিউল। ধারদেনার টাকা, ব্যাংক লোন পরিশোধ ও সংসারের শান্তির আশায় দিনরাত খাটতে থাকেন সে। কিন্তু বাড়িতে রেখে যাওয়া সন্তান সম্ভবা স্ত্রী লুপা প্রসবকালীন রক্তক্ষরণে মারা যান একই বছরের অক্টোবরে।
সদ্য ভূমিষ্ঠ আব্দুর রহমান রকির চেহারাটাও মা লুপা বেগম ঠিকমত দেখে যেতে পারেন নি। রকিও মায়ের কোলে চড়ে আদর, খুনসুটিতে মেতে থাকতে পারেনি। প্রিয়তমা স্ত্রীর অকাল প্রয়াণে বিদেশের মাটি ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন বদরুল। কোলে তুলে নেন মা হারা শিশু আব্দুর রহমান রকিকে। সদ্য মা হারা দুই কন্যা মিম ও জিম বাবাকে কাছে পেয়ে শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এখানেও বিধি বাম, ধার দেনা, লোনের চিন্তা, স্ত্রী শোক, আদরের সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তায় ষ্ট্রোক হয় বদরুলের। সেও তিন সন্তানকে এতিম করে ২০২০ সালের ৩১ মে বাসিন্দা হন অন্ধকার কবরের। স্ত্রী লুপার মৃত্যুর ঠিক ছয় মাস পরেই বদরুলের মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়ে তিন সন্তান মিম জিম ও রকি। আত্বীয় স্বজনেরা হয়ে পড়েন বাকরুদ্ধ।
এভাবেই খেয়ে না খেয়ে অনাদর অবহেলায় বড় হচ্ছে, এতিম তিন সন্তান মিম, জীম ও আব্দুর রহমান রকি।
স্ত্রী লুপা মারাযাওয়ার মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে মৃত্যু হয় বদরুলের। এদিকে ব্যাংক লোন মওকুফের জন্য আত্বীয় স্বজনেরা প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র যোগাড় করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের গোপালগঞ্জ শাখায় আবেদন করেন।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সুত্রে জানা যায়, কোন গ্রাহক ও নমিনী যদি ২২ মাসের মধ্যে মৃত্যু বরন করেন, তাহলে উক্ত গ্রাহকের লোন মওকুফ করা হয়। বদরুলের সন্তান, আত্বীয় স্বজনেরা ভেবেই নিয়েছিল লোন বুঝি মাফ হয়ে গেছে ৷ মওকুফ আবেদনের তিন থেকে সাড়ে তিন বছর পরে ২৪ সালে এসে কিস্তির জন্য চাপ প্রয়োগ শুরু করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মুকসুদপুর শাখা।
এমন সংবাদে মা বাবা হারা এতিম তিন ভাই বোনের মাথায় যেন বজ্রপাত নেমে আসে। হতবাক হয়ে যান বদরুলের আত্বীয় স্বজন, প্রতিবেশী ও গ্রামের লোকেরা। তারা গভীর ক্ষোভের সাথে জানান, সব ধরনের কাগজপত্র যথা সময়ে ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় গন্যমান্য ও জনপ্রতিনিধিরাও অবগত আছেন ঋন মওকুফের বিষয়টি। এখন ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, কাগজপত্র তারা পাননি। পেলে ঋন মওকুফ হয়ে যেত।
বদরুলের মৃত্যুর পর সমস্ত কাগজপত্র জমা দেয়ার বিষয়ে প্রতিবেশী ফিরোজ মিয়া জানান, কাগজপত্র সব জমা দেয়া হয়েছিল। আমরা অনেকেই ব্যাংকে গিয়েছিলাম। সাংবাদিক সৈয়দ মিরাজুল ইসলামও আমাদের সাথে ব্যাংকে গিয়েছিলেন। বদিউলের ঘর বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নাই। ঘর বাড়ি বিক্রি করে লোনের টাকা পরিশোধ করলে, এতিম বাচ্চা গুলো কোথায় যাবে?
গ্রামবাসী মিরাজুল ইসলাম বলেন, বদরুল আলম বরকতের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ও বাড়িতে চলে আসে। ৫ থেকে-৬ মাসের মাথায় বদরুলও মারা যায়। এখন ব্যাংক লোন শোধ করার মত অবস্থা ওদের নাই।
আরেক প্রতিবেশী লুলু শিকদার বলেন, ব্যাংকে সব ধরনের কাগজপত্র দেয়া হয়েছিল। এখন সব দায়ভার ব্যাংকের। তারা যদি এতিম বাচ্চা গুলোরে চাপ দেয় তাদের আর যাওয়ার জায়গা থাকবেনা।
গোপালগঞ্জ জেলা প্রসক্লাবের সাধারন সম্পাদক সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম, বলেন, বদরুল আলম বরকতের মৃত্যুর পর ওরা আমার কাছে আসে। ওদের সাথে আমি গোপালগঞ্জ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে যাই। তখন ব্যাংক থেকে আমাদের বলা হয়, কাগজ পত্র দিয়ে যান, সেগুলো আমরা হেড অফিসে পাঠাবো। হেডঅফিস থেকে যে সিদ্ধান্ত হয়, সেটাই বাস্তবায়ন হবে। পরে জানতে পারি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক বদরুলের মা ও এতিম বাচ্চাদের কিস্তির জন্য চাপ দিচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক মুকসুদপুর শাখা ব্যবস্থাপক মো. সেলিম বলেন, উনাদের আবেদনের কপি আমি ফাইলের কোথাও পাই নাই৷ পেলে অবশ্যই মওকুফ করা যেত। এটা অনেকদিন আগের বিষয়, আবেদনের কপি থাকলে অবশ্যই বিষয়টা হত। কেন হবে না এটা তাদের অধিকার। আমাদের কাছে যথা সময়ে আবেদনের কপি পৌছালে অবশ্যই তারা মওকুফ পেত।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক মুকসুদপুর শাখা ব্যবস্থাপক বলছেন, তিনি ঋন মওকুফের কোন আবেদনের কপি পাননি। এদিকে, মৃত বদরুলের আত্বীয় স্বজন প্রতিবেশীরা বলছেন, আবেদনের কপি জমা দেয়া হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গন্যমান্য ব্যক্তিরা সাংবাদিক নেতা উপস্থিত থেকেই আবেদন কপি জমা দেন।
জেবি/এসবি