ক্ষমতার দাপটে ডিপিডিসি’র সর্বেসর্বা ফজিলাতুন্নেছা
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০২:১২ অপরাহ্ন, ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫

# অযোগ্য হয়েও পেয়ে যান চাকরি
# ঠিকাদারের অফিসে টাকা ভাগ বাটোয়ারার বৈঠক
# ইন্সপেকশনের নামে পরিবার নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ
# বিভাগীয় পদক্ষেপ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট নয়
- ড. ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
# দুর্নীতি দমনে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন
- ড. ইকবাল মাহমুদ সাবেক চেয়ারম্যান, দুদক
ফজিলাতুন্নেছার যোগ্যতা ছিলো না ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড(ডিপিডিসি)-তে চাকরি পাওয়ার। যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তার জীবন বৃত্তান্তের (সিভি) জায়গা হয় ডাস্টবিনে। সংস্থাটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউল মাসুদের নির্দেশনায় ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া সিভি তুলে নিয়ে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জানা গেছে, আতাউল মাসুদ এবং ফজিলাতুন্নেছার বাড়ি একই এলাকায়। সেই সুবাদে অযোগ্য হয়েও চাকরি পেয়ে যান তিনি। চাকরি পেয়ে যেনো আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান ফজিলাতুন্নেছা। ডিপিডিসির আওতায় জি টু জি প্রকল্পের তিনিই সর্বেসর্বা।
জিটুজি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্প শুরুর আগে তিনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান টিবিএ, অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক সিরাজউদ্দৌলা এবং টিবিএর লোকাল এজেন্টের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এজেন্টের বাড্ডা অফিসে বসে কাজ শুরু করেন। ওখানে বসেই প্রকল্পের সার্বিক পরিকল্পনা ও লুটপাটের হিসাব-নিকাশ করা হয়। আরো জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, তৎকালীন ডিপিডিসির চেয়ারম্যান এবং সাবেক বিদুৎ সচিবের সাথে সখ্যতা ছিলো ফজিলাতুন্নেছার।
প্রকল্পের খরচ এবং পণ্যের দাম অতিরিক্ত হওয়া নিয়ে বুয়েটের জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, আপত্তি জানালে তাকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করেন আহমদ কায়কাউস। ফেসিস্ট সরকারের অত্যান্ত ক্ষমতাবান ও দুর্নীতি পরায়ন আহমদ কায়কাউস এর ক্ষমতায় বলিয়ান হয়ে ফজিলাতুন্নেছা ম্যানেজমেন্ট লেভেলে নানা প্রভাব খাটিয়ে প্রচুর বিদেশে ইন্সপেকশনের সুযোগ নিতেন। একদেশ থেকে এসে পরবর্তী ফ্লাইটে অন্য দেশে যেতেন। বড় কর্তাদের প্রভাবে তিনি যতবার বিদেশে ইন্সপেকশনে গিয়েছেন প্রতিবারই পুরো পরিবারকে নিয়ে গেছেন। তার পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্টগুলো দেখলেই বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। জানা যায়, প্রকল্পের ঠিকাদারের টাকায় তিনি এই বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।
পরবর্তীতে নতুন সচিব আসলেও আহমদ কায়কাউসের মাধ্যমে তাকেও হাত করে নেন ফেসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী ফজিলাতুনেছাা। তিনি অনেককে সুপারসীড করে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। এ নিয়ে ডিপিডিসির কর্মকর্তারা অনেক অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অবহিত করলেও কোন লাভ হয়নি। কেননা আহমদ কায়কাউসের মাধ্যমেই ফেসিস্ট সরকারের আরেক দোসর সাবেক এমডি ডিপিডিসির কর্মকর্তাদের কোন তোয়াক্কা করতেন না। অভিযোগ আছে, ডিপিডিসিতে ফজিলাতুন্নেছার কথাই শেষ কথা। যে কোনো কর্মকর্তা তার কথা না শুনলে প্রভাব খাটিয়ে তাদের বদলি করে দিতেন।
জি টুজি প্রকল্পে প্রচুর মালামাল কেনা হলেও ব্যবহার হয়েছে খুবই কম। ব্যবহার না থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ফজিলাতুন্নেছা ও হাদীর সহযোগিতায় প্রকল্পের প্রচুর ক্যাবল চুরি হয়েছে।
২০২৩ সালে এই প্রকল্পের মালামাল ক্রয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি ধরা পড়ে বিভাগীয় তদন্তে। দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে, জার্মান থেকে পণ্য কেনার কথা থাকলেও পণ্য আনা হয় চায়না থেকে। এতে করে ডিপিডিসি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয় কোন কোন কর্মকর্তা। যার মধ্যে ফজিলাতুন্নেছা অন্যতম। অগণিত অভিযোগ থাকার পরেও প্রকল্পের শুরু থেকে এখনো বহাল আছেন ফজিলাতুন্নেছা। জিটুজি প্রকল্পের ফজিলাতুন্নেছা ক্ষমতার লড়াইতে জিতে যান সব সময়। সরকার পরিবর্তন বা যেকোনো পরিবর্তনে তার বদলি বা পরিবর্তন হয়নি অদৃশ্য ক্ষমতাবলে। ফজিলাতুন্নেছা আওয়ামী লীগের আমলে অন্যতম সুবিধাভোগী হয়েও এখনো বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন।
পরামর্শদাতার সুপারিশ: ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারী থেকে ২ এপ্রিল পরামর্শদাতার অনুমোদিত জিটিপি অনুসারে ৬৯ সেট ১৩২ কেভি ক্যাবলেরক্রস বন্ডিং জয়েন্টসমূহ জার্মানিতে ম্যানুফ্যাকচার ও প্যাকেজিং করে পোল্যান্ড থেকে শিপমেন্টের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও সরেজমিনে দেখা যায় যে মালামালসমূহ চায়না থেকে শিপমেন্ট করা হয়েছে যা পিএসআই রিপোর্ট এবং অনুমোদিত জিটিপির ব্যত্যয়। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এ প্রকল্পে পরামর্শদাতা নিয়োগ করা হয়েছে অধিকতর টেকনিক্যাল সার্ভিস নেয়ার জন্য। এ প্রকল্পে পরামর্শকদাতা কর্তৃক পিএসআই/ফ্যাট/পিএলআই সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ প্রদান করা হয় এবং তার ভিত্তিতেই প্রকল্প দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বর্ণিত মালামালসমূহের পিএসআই/ফ্যাট পরামর্শকদাতার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের পরামর্শকদাতা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয় মর্মে মতামত দিয়েছেন।
পিএলআই কমিটির সুপারিশ: ২০২২ সালের পহেলা নভেম্বর ও ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল পিএলআই কমিটি জার্মানি থেকে প্যাকেজিং এবং শিপমেন্টের পরিবর্তে চায়না থেকে করার বিষয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির কাছ থেকে কোন সদুত্তর মেলেনি। পিএলআই কমিটি নির্ধারিত দেশ নির্ণয় সাপেক্ষে মালামাল গ্রহণ করতে পারে মর্মে সুপারিশ করেছেন।
কমিটি গঠন: ১৩২ কেভি ক্যাবল আনুষাঙ্গিক ৪৫তম শিপমেন্টে ২০২২ সালের ১লা নভেম্বর উপস্থাপন হয়। ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর কমিটির গঠন করা হয়। পোস্ট ল্যান্ডিং পরিদর্শন এ দেখা যায় যে ইপিসি চুক্তি অনুমোদিত জিটিপি এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে মালামালসমূহ জার্মান থেকে শিপমেন্ট না করে চায়না থেকে পুনরায় প্যাকেজিং এবং শিপমেন্ট করা হয়েছে এই অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধান প্রকৌশলী, উন্নয়নকে সভাপতি করে ৫ সদস্য’র কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির সুপারিশ: ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই কমিটি সকল কিছু যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ করেন যে ইপিসি চুক্তি ও অনুমোদিত জিটিপির ব্যত্যয় ঘটিয়ে মালামালসমূহ পোল্যান্ড থেকে সরাসরি বাংলাদেশে শিপমেন্ট না করে চায়না থেকে শিপমেন্ট করা হয় এবং পরবর্তীতে চায়না থেকে নতুন করে প্যাকিং এবং শিপমেন্টের করার ফলে ১৩২ কেভি ক্যাবল আনুষাঙ্গিক মালামাল চায়নাতে পরিবর্তন হওয়ার আশংকা থাকায় ১৩২ কেভি ক্যাবল আনুষাঙ্গিক সমূহের জার্মান হিসেবে নিশ্চিত হওয়া যায় না বিধায় ৪৫তম শিপমেন্টের ১৩২ কেভি ক্যাবল আনুষাঙ্গিক সমূহ গ্রহণ করা যায় না।
জানা গেছে, ৪৫তম শিপমেন্টের মত একইভাবে ২৩তম ও ৪৩তম শিপমেন্টের ক্ষেত্রে হয়েছে এবং মালামালসমূহ পরামর্শকদাতা, পিএলআই কমিটির গ্রহনের সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প দপ্তর মালামাল গ্রহণ, বিল পরিশোধ করা হয়েছে এবং মালামালসমূহ সাইটে ব্যবহৃত হয়েছে।
সূত্র বলছে, কমিটি মালামালসমূহ না নেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করলেও পরবর্তীতে প্রকল্প পরিচালক ফজিলাতুন্নেছাকে নিয়ে গঠিত অপর একটি কমিটি ৪৫তম শিপমেন্টের মালামালসমূহ নেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেন; ফলে কোনরূপ দাম সমন্বয় ব্যতিরেকে ঠিকাদার চায়নার মালামাল সরবরাহ করেও জার্মানির মালামালের সমপরিমাণ বিল ডিপিডিসি থেকে গ্রহণ করেন। সাধারণত চায়নার মালামালের দাম ইউরোপ (জার্মানি) এর মালামালের চেয়ে ২০-৩০% কম হয়। যার ফলে ডিপিডিসির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং একই সাথে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক সহ অন্যান্ন কর্মকর্তারা। এবিষয়ে ম্যানেজমেন্ট জড়িত আছে বলে জানা যায়।
শিপমেন্টের মালামাল গ্রহণ: কমিটির অনুসন্ধানে দেখা যায় যে ২৪তম ও ৪৩তম শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও একইভাবে জার্মানির পরিবর্তে চায়না থেকে শিপমেন্টে করার অভিযোগ রয়েছে। জিটুজি প্রকল্পের ৪৫তম শিপমেন্টে ১৩২ কেভি ক্যাবল আনুষাঙ্গিক এর ২০২২ সালের ১লা নভেম্বর পোস্ট ল্যান্ডিং পরিদর্শনে দেখা যায় যে ইপিসি চুক্তি ও অনুমোদিত জিটিপি এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে মালামালসমূহ জার্মান থেকে শিপমেন্ট না করে চায়না থেকে পুনরায় প্যাকেজিং এবং শিপমেন্ট করা হয়েছে। জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাজিবুল হাদী ও অপর এক কর্মকর্তার মাধ্যমে পিএলআই করে সেই মালামালসমূহ গ্রহণ করেন। এভাবে ৬০ কোটি টাকার মালামাল জার্মানির পরিবর্তে চায়না থেকে আনা হয়। সাধারণত চায়নার মালামাল এর মূল্য ইউরোপ (জার্মানি) এর মালামালের চেয়ে ২০-৩০% কম হয় বিধায় প্রকল্পের কতিপয় কর্মকর্তা প্রায় ১২ কোটি টাকা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে তথা পাবলিক মানি তশ্রুব হয়েছে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ফজিলাতুন্নেছাকে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর মেলেনি।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। দুর্নীতি দমনে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি দমন করা যাবে না।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে যেসব আইন, বিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেসব বিধিমালা রয়েছে তা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। ব্যতিক্রম হচ্ছে চুনোপুঁটির বেলায় এসব আইন প্রয়োগের দু-একটি ঘটনা। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে প্রভাবশালী চক্রের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয় না।
তিনি বলেন, আইন যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলকভাবে প্রয়োগ করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথাকথিত বিভাগীয় পদক্ষেপ দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর ভূমিকা নিলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
প্রিয় পাঠক, আগামী পর্বে থাকছে জিটুজি প্রকল্পের হরিলুটের মাস্টার ফজিলাতুন্নেছা
আরএক্স/