চট্টগ্রামের ‘বন মাফিয়া’ মোল্যা রেজাউল
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন, ১১ই মার্চ ২০২৫

# নিয়ন্ত্রণ করেন সিন্ডিকেট, অনিয়মই তার কাছে নিয়ম
# আ.লীগের সুবিধাভোগী হয়েও আছেন বহাল তবিয়তে
# হাসান মাহমুদের সঙ্গে সক্ষতায় বারবার রক্ষা পেয়েছেন
# বিচারের আওতায় আনতে হবে
- ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক টিআইবি
# প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে
- আমীর হোসাইন চৌধুরী, প্রধান বন সংরক্ষক
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষণ বিভাগে একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে মোল্যা সিন্ডিকেটের। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক কিংবা শ্রমিক নেতা নয়, সরকারি চকরিজীবী বন সংরক্ষক (সিএফ) মোল্যা রেজাউল করিম এই সিন্ডিকেটের প্রবর্তক ও নিয়ন্ত্রক। সিন্ডিকেটের হোতা হিসেবে দুর্নীতি, অনিয়ম আর ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মোল্যা রেজাউল কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক দাপট দেখিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগ পালালেও ক্ষমতার দাপট কমেনি এই সুবিধাভোগীর। ঘুষ ছাড়া কিছুই বোঝেন না এই দাপুটে কর্মকর্তা।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারি গাছ কাটার ক্ষেত্রে উপজেলা পরিষদের রেজুলেশন, টেন্ডার ও বন বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু মোল্যা রেজাউল করিমের কাছে নিয়মের কোনো মূল্য নেই। তিনি কোনোকিছুর তোয়াক্কা করে না দেদারচে সরকারি গাছ বিক্রি করেন। এ সংক্রান্তে অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বন অধিদফতর মোল্যা রেজাউল করিমের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে একের পর এক চিঠি দিলেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। সূত্র বলছে, চাকরি জীবনের শুরুতে রাঙ্গামাটি দক্ষিণ বন বিভাগের কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা পদে প্রশিক্ষণকালেই মোল্যা রেজাউল ঘুষ লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন। কাপ্তাই রেঞ্জে সেগুন বাগান বিক্রি করে বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন। পরবর্তীতে মোল্যা রেজাউলের বিরুদ্ধে তৎকালীন সহকারী বন সংরক্ষক শাহাবুদ্দিন লিখিত অভিযোগ করেও দুর্নীতি থামেনি। ফেনী ডিভিশনের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি বাগান সৃজন ও ইকোপার্ক প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেন। তদন্তে প্রমাণ পেয়ে সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ আলী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বন মন্ত্রণালয়ে লিখিত প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগিতায় সেই ফাইল মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ধামাচাপা পড়ে যায়। মোল্যা রেজাউল বাগেরহাট ডিভিশনের দায়িত্বে (ডিএফও) থাকাকালীন পিরোজপুরে ইকোপার্ক নির্মাণ প্রকল্পের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ সূত্র বলছে, মোল্যা রেজাউল করিমের দুর্নীতির বন অধিদফতরে তিনি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে ছিলো তার বিশেষ সখ্যতা। সেই কারণে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নির্বিঘ্নে বিপুল কালো টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি।
২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুছ আলী পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করেন, মোল্যা রেজাউল ফেনীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ২০১০-২০১১ ও ২০১১-২০১২ আর্থিক সালে বাগান উত্তোলনে ২ কোটি ৩১ লাখ ২৯ হাজার ৬৮০ টাকা ব্যয় করেন। তবে বাগানটি ব্যার্থ হওয়ায় সরকারি বরাদ্দের ওই পরিমাণ টাকা অর্থিক ক্ষতি হয়। মোল্যা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ও ৭ মে ২০১৫ তারিখে দুইবার চিঠি দেওয়া করা হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলেও প্রধান বন সংরক্ষকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
বন বিভাগ সূত্র বলছে, মোল্যা রেজাউল করিম ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ আর্থিক সালে সিভিল অডিট অধিদফতর অডিটকালে ১২টি সাধারণ অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও টিকাটুলি বলধা গার্ডেনের পরিচালক থাকাকালীন সময় তার বিরুদ্ধে সর্বমোট ২০ কোটি টাকা উন্নয়ন কাজের বরাদ্দের সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। গভীর নলকূপ স্থাপনে ৩০ লাখ টাকা খরচ হলেও দেখানো হয় সাড়ে ৭০ লাখের বেশি। পতিত পুকুর খননের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎসহ ভুয়া প্যাড, কাগজ এবং বিল ভাউচারের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
যদিও মোল্যা রেজাউল করিম সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কিছুই সত্য না। কোনো দুর্নীতির সঙ্গে আমি জড়িত নই। আপনার বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ কেনো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি উচ্চস্বরে বলেন, সব সাংবাদিক খারাপ। একজনও ভালো মানুষ পেলাম না। একপর্যায় ক্ষেপে গিয়ে ‘নিউজ করলে আমি আপনাকে দেখে নেবো’ বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন তিনি।
এ বিষয়ে দুদকের পরিচালক (জনসংযোগ) আকতারুল ইসলাম বলেন, যে কোনো অভিযোগ দাখিল হলে যাছাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দুর্নীতির প্রমাণ পেলে যাছাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের ভেতরে যখন ক্ষমতার অপব্যবহারের চিন্তা থাকে তখনই দুর্নীতি হয়। আর দুর্নীতিকে রোধ করতে নিজেদের মনোভাবকে পরিবর্তন করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। না হলে দুর্নীতি বন্ধ হবে।
এ বিষয় প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
আরএক্স/