সোনা মনি ও শফিকুলের অনিয়মের সোনার হরিণ
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১১:৪৮ এএম, ২৭শে আগস্ট ২০২৫

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) হল বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা, যা রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বৃহৎ শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। তবে, এর কার্যক্রমে একাধিক অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কখনও কখনও প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যেমনটি ঘটেছিল গত ৯ এপ্রিল রামপুরার একটি নতুন সার্ভিস সংযোগের সময়।
এই সংবাদটি সেই ঘটনা এবং এর পরবর্তী অনুসন্ধান এবং তদন্তের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছে, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি ও অবহেলার সমস্যার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। একজন কর্মীর মৃত্যুর পর, তদন্তের মাধ্যমে যে দায়িত্ববোধ ও প্রশাসনিক প্রতিকার প্রত্যাশিত ছিল, তা না হওয়ায়, এই ঘটনাটি আরো বড় এক সমস্যার প্রকাশ ঘটায় যেখানে সঠিক বিচার এবং যথাযথ তদন্তের অভাব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
সূত্র বলছে, মগবাজার ডিভিশনে প্রাণহানির ঘটনায় বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরও ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ এক বিশেষ কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের সাময়িক বরখাস্তর আদেশ প্রত্যাহার করে গত সোমবার ঐ দুই প্রকৌশলী মাহে আলম ও আবেদ আলীকে প্রাইজ পোস্টিং দেয়।
জানা গেছে, ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন) সোনা মণি চাকমা ও নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউএম শফিকুল ইসলাম নেপথ্যের কলকাঠি নেড়েছেন।
সূত্র জানায়, এই দুই ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা ঐ দুই প্রকৌশলীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। সূত্রটি আরও জানায়, সংস্থাটির অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ভুল বুঝিয়ে এই কাজটি করিয়ে নেন। এ বিষয়ে সংস্থার একাধিক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই দুই নির্বাহী পরিচালকের বিভিন্ন রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
মৃত্যু এবং দায়িত্বের অবহেলা: গত ৯ এপ্রিল বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা শহরের ১৫/১৫ পশ্চিম রামপুরা এলাকায় তামিম ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি কোম্পানির কর্মী কামরান হোসেন এলটি লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ হারান। এই দুর্ঘটনা, যা একটি কর্মীর নিরাপত্তাহীনতার ফলে ঘটে, ছিল এক ধরনের গাফিলতি এবং অবহেলার ফল। নিহত কর্মী কামরান হোসেনের মৃত্যুতে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা ছিল না, বরং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফলস্বরূপ ঘটে থাকতে পারে।
ডিপিডিসি এবং বিদ্যুৎ বিভাগের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল এবং তারা অভিযোগ করেন, এই দুর্ঘটনা একটি পরিকল্পিত অবহেলার ফল, যা অনুকূল পরিস্থিতিতে ঘটানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, সঠিক তদারকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়নি, এবং এই কারণে বিদ্যুৎ কর্মীরা বিপদে পড়েছেন। এর ফলস্বরূপ, তদন্তে অভিযুক্ত হন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহে আলম এবং সহকারী প্রকৌশলী শেখ আবেদ আলী।
দায়িত্বে গাফিলতি: তদন্ত, বরখাস্ত এবং প্রাইস পোস্টিং তদন্তের পর, ১৫ এপ্রিল এই দুই কর্মকর্তা দায়ী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যদিও তদন্ত কমিটি তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনে, তারপরও ২৫ আগস্ট, ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নতুন পদে নিয়োগ প্রদান করে, যা পুরো ঘটনার ওপর আরও বেশি প্রশ্ন তৈরি করেছে। এটা স্পষ্ট যে, দায়িত্বে অবহেলা এবং দুর্নীতির কারণে এই দুই কর্মকর্তা বরখাস্ত হওয়ার পর তাদের ফের নতুন দায়িত্ব প্রদান করল, যা দুর্নীতির চক্রের ভিতরে ক্ষমতার অবাধ প্রবাহের একটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়। এর মাধ্যমে তাদের শাস্তি না দিয়ে বরং একটি পুরস্কৃত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ, যারা তদন্তে দায়ী বলে চিহ্নিত, তাদের শাস্তি কিংবা সংস্কারের অভাবের কারণে এ ধরনের দুর্নীতি পুনরাবৃত্তি হতে থাকে।
দুর্নীতি এবং অর্থের প্রভাব: অভিযোগ উঠেছে যে, এই কর্মকর্তাদের পুনর্বহাল করার পেছনে প্রচুর অর্থের প্রভাব রয়েছে। কিছু সূত্রের দাবি, ৩০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে তাদের বিরুদ্ধে দায় মাফ করা হয়েছে এবং তাদের পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই ঘটনার মাধ্যমে একটি প্রশ্ন ওঠে, যেখানে অর্থ এবং ক্ষমতার সংযোগের কারণে সঠিক বিচার, বিচারবোধ এবং সুশাসনের বোধ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন অ্যান্ড এইচআর) সোনা মনি চাকমা বলেন, “এই ঘটনা তদন্ত আমি করিনি। তাই অনুমানভিত্তিক কোনো মন্তব্য করাকে সমীচীন মনে করি না। আমি কোনো রিপোর্ট দেইনি। এ বিষয়ে এমডিকে জিজ্ঞেস করুন।”
এদিকে, ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তাকে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
এমনিভাবে, ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নূর আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হয়, তবে তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে খুদে বার্তা পাঠালেও তার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ডিপিডিসির শাসনহীনতা ও দুর্নীতির প্রসার: এই ঘটনায় যে বিষয়টি সবচেয়ে হতাশাজনক, তা হল সঠিক বিচার ও তদন্তের অভাব। কর্মীর মৃত্যু, যেটি একটি নিরাপত্তা প্রটোকল না মানার কারণে ঘটেছে, তা কোনো ধরনের সঠিক এবং সময়মতো বিচার প্রাপ্ত হয়নি। বরং, গাফিলতি এবং অবহেলা দায়মুক্ত হয়ে সামাজিক ও প্রশাসনিক বিচারবোধকে অপমানিত করেছে। বিশেষত, যখন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্মকর্তাদের এমন দুর্ঘটনার পর অভিযুক্ত করা হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া জনগণের মধ্যে আস্থা সংকট সৃষ্টি করে। এখানে আইনি ও প্রশাসনিক বিলম্বের বিষয়ও উঠে আসে। যখন কোনো ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে বিলম্ব হয়, তখন দুর্নীতি ও অবহেলা আরও গভীর হয়, এবং এটি ভবিষ্যতে আরো ভয়ানক ঘটনার জন্ম দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া এবং তদন্তে দেরি হওয়া এই ধরনের দুর্নীতির সংস্কৃতিকে আরো শক্তিশালী করে।
সামাজিক ও ন্যায়বিচারের উপর প্রভাব: এ ধরনের ঘটনা সামাজিক আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জনগণ যখন ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে, তখন তারা সঠিক ব্যবস্থা ও শাস্তির আশা করে। কিন্তু বাস্তবে তারা দেখে, একেকজন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা কেবল বরখাস্ত হয়ে নয়, বরং পুরস্কৃত হয়ে নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতি, যেখানে অপরাধীকে পুরস্কৃত করা হয় এবং অপরাধের শিকার মানুষ কেবল অসহায় হয়ে পড়ে, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
দুদক এবং টিআইবির প্রতিক্রিয়া: দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, “সরকারি কর্মকর্তারা যখন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তারা যাতে আরো অপরাধ না করতে পারে, তার জন্য যথাযথ শাস্তি ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।” তিনি আরও যোগ করেন যে, এ ধরনের দুর্নীতি মোকাবেলা করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামা বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে, এসব দুর্নীতি আরও বাড়বে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে।
সুশাসন ও ন্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ: এই ঘটনা কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি, অবহেলা এবং বিচারহীনতার একটি বড় চিত্র তুলে ধরে। যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুর্নীতি প্রবাহিত হয় এবং তাদের কর্মকর্তারা অবৈধ উপায়ে দায়মুক্তি পায়, তখন সেটা একটি সিস্টেমের দুর্বলতা এবং দেশটির শাসনব্যবস্থার অপরাধী হয়ে ওঠে।
এ কারণে, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দুর্নীতি ও অবহেলার বিরুদ্ধে কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত। যদি না করা হয়, তাহলে দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে আরো বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
আরএক্স/