বজ্রপাত আতঙ্কে সুনামগঞ্জের হাওরবাসী


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


বজ্রপাত আতঙ্কে সুনামগঞ্জের হাওরবাসী

গেল বেশ কয়েক বছর থেকে হাওড়ে বজ্রপাত যেন এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাড়িয়েছে। দুই দশক আগে বজ্রপাতে গাছপালার ক্ষতি হলেও মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে চিত্রটা এবার বদলে গেছে, বর্ষা মৌসুমে এখন প্রায় প্রতিদিনই কাগজের পাতা বা টেলিভিশনের শিরোনামে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর খবর শোনা যায়। ২০১৬ সাল ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, ওই বছর প্রায় ২৭০ জন মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারান। এরপরই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। এর পূর্বে ১২টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের নামের তালিকায় ছিল না বজ্রপাত, তাই ১৩ তম দুর্যোগ হিসেবে বজ্রপাত লিপিবদ্ধ হয়। বর্তমান সময়ে বজ্রপাত সত্যিকার অর্থেই আতঙ্কের নাম। বিশেষ করে খেটেখাওয়া কৃষক যাদের কিনা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাজ করতে হয়। 

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশে বজ্রপাতে হতাহত সংখ্যার প্রায় সত্তর শতাংশই কৃষক! এইতো গত দুই দিন আগে কৃষিকাজ করাকালীন সময়ে দিরাইয়ের হাওরে বজ্রপাতে দু’জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। 

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, দেশে এপ্রিল ও মে মাসে সব থেকে বেশি বজ্রপাত হয় যার মধ্যে কেবল মে মাসেই হয় ২৬ শতাংশ। আর এই সময়ে গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা কৃষিকাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে থাকে। আর তাই বজ্রপাতে কৃষকরা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়। এছাড়াও গোসল করার সময় ও মাছ ধরতে গিয়ে অনেকে বজ্রপাতের শিকার হন। অনেক সচেতন ব্যক্তিও বজ্রপাতের সময় সঠিক নিয়মগুলো মানতে চান না, এতে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, কিন্তু অনেকেই এসবের তোয়াক্কা করেন না। 

হাওরে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও বেড়ে যাচ্ছে। বিস্তৃত হাওর এলাকাতে যেহেতু বড় কোনো গাছপালা নেই সেজন্য বজ্রপাতে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। হাওর এলাকায় বজ্রপাতে প্রাণহানি কমিয়ে আনার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মাধ্যমে হাওরে বজ্রপাত প্রতিরোধক  স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বজ্রপাত বেড়ে যাওয়াকে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলাফল বলছেন আবহাওয়াবিদরা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও মৃত্যু রোধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। শহর এলাকায় বিল্ডিংগুলোতে ব্যক্তি উদ্যোগে বজ্রপাত প্রতিরোধক  স্থাপন করা হলেও গ্রামাঞ্চলে মানুষের কাজ করতে হয় মাঠে, তাই গ্রামাঞ্চলে কিংবা হাওর এলাকাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। 

বিশেষজ্ঞরা তাই কৃষিজমিতে কিংবা হাওর অঞ্চলে কৃষকদের প্রাণ বাঁচানো ও নিরাপদে কাজ করার ব্যবস্থা করতে বজ্রপাত প্রতিরোধক স্থাপানের দাবী জানান। 

বজ্রপাতের বিষয় নিয়ে কথা হলে দেখার হাওরের কৃষক আব্বাস আলী জানান, বর্ষা মৌসুম এলেই মানুষের মুখে শুধু বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর শুনি। জেলার কোন না কোন স্থানে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই। ঘন ঘন এরকম সংবাদ কানে পৌছালে মনের মধ্যে এমনিতেই এক ধরনের ভীতির কাজ করে। তাই বর্ষায় হাওরপাড়ের কৃষকরা বজ্রপাত আতঙ্ক সাথে নিয়েই মাঠে কাজ করেন। 

অপর এক কৃষক মন্তাজ মিয়া জানান, সরকারের কাছে আমাদের মত কৃষকদের একটাই দাবী হাওরাঞ্চলে যেন বজ্রপাত প্রতিরোধক স্থাপন করা হয়। তা না হলে আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হোক। যাতে আমরা বজ্রপাত চলাকালীন সময়ে হাওরে যারা কাজ করি তারা এই আশ্রয়কেন্দ্র এসে জীবন রক্ষা করতে পারি। তা না হলে খোলা হাওরে আমাদের মৃত্যুকে সাথে নিয়েই কাজ করতে হবে। 

আবহাওয়াবিদ নাসির উদ্দিন বলেন, বজ্রপাতের কারণে প্রাণহানির ঘটনা কমিয়ে নিয়ে আসতে আরও উদ্যোগী হতে হবে। বর্ষা মৌসুমে কৃষকদের নিরাপদে মাঠে কাজ করার জন্য বজ্র প্রতিরোধক স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সচেতন করতে ও বজ্রপাতের সময় করণীয় বিষয়গুলোকে ভালোভাবে তুলে ধরতে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের সামনে কিংবা রাস্তার মোড়ে বজ্রপাতের সময় করণীয় বিষয়গুলো বিলবোর্ড কিংবা পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়াও বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে আরো নানামুখী উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবী।

এসএ/