বিশ্রাম করলে তো ক্ষিদা যায় না: ৯০ বছরের নজরুল


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


বিশ্রাম করলে তো ক্ষিদা যায় না:  ৯০ বছরের নজরুল

নব্বই বছর বয়সেও নজরুল ইসলাম ভাঁড় ঘাড়ে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ফেরি করে ঝাল চানাচুর ও শুটকী বিক্রি করে অতি কষ্টে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। বয়স ৯০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিশ্রামের সুযোগ নেই। কারণ ভাঁড়ে করে চানাচুর ও শুঁটকী বিক্রি করে দু-মুঠো খাবার জোটে নজরুল ইসলাম ও তার সহধর্মনী মজিরনের। নজরুল ইসলামের বাড়ী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্তঘেষা খলিশাকোঠাল গ্রামে। তিনি ঐ এলাকার মৃত কাচু শেখের ছেলে। ১ ছেলে ও ১ মেয়ে ব্যস্ত নিজের সংসার নিয়ে। তার নেই কোন আবাদী জমি। মাত্র ১০ শতক জমিতে জরাজির্ণ একটি টিনসেট ঘরে স্ত্রীসহ অতিকষ্টে বসবাস করছেন। সেই সাথে নব্বই বছর বয়সেও সংসারের ঘানি টানছেন ক্লান্ত নজরুল ইসলাম। গ্রামের সবাই বিদ্যুৎসেবা পেয়ে থাকলেও অর্থের অভাবে বিদ্যুৎসেবা থেকে বঞ্চিত নজরুল ইসলাম। নব্বই বছরের নজরুল ইসলাম তার স্ত্রীকে নিয়ে বছরের পর বছর কুপির আলো দিয়ে অনেকটা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
 
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গজেরকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পরিত্যাক্ত ভবনের বারান্দার ছেঁড়া গেঞ্জি গাঁয়ে এক কোণায় বসে ঝাল চানাচুর বিক্রি করছেন নজরুল ইসলাম। তার কাছ থেকে ঝাল চানাচুর কিনে খাচ্ছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিশু শিক্ষার্থীসহ ঐ এলাকার মানুষজন। একই দিনে স্কুল ছুটির পর কুরুষাফেরুষা এলাকায় ঝাল চানাচুর ও শুটকী বিক্রি করতে দেখা যায়। তাই দু-মুঠো খাবারের জন্য  নব্বই বছর বয়সেও নজরুল ইসলাম ভাঁড় ঘাড়ে নিয়ে ঝাল চানাচুর ও শুটকী বিক্রি করছেন গ্রামে গ্রামে। প্রতিদিন পথে ঘাটে প্রান্তরে ঘুরে ঝাল চানাচুর ও শুটকী বিক্রি করে আয় করেন মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। চানাচুর বিক্রির সামান্য আয় ও দুই স্বামী-স্ত্রীর বয়স্ক ভাতার টাকা দিয়ে কোন রকমেই দু-বেলা দু-মুঠো খাবার জোটে চানাচুর বিক্রেতা নজরুল ইসলামের। নজরুল ইসলামের শরীরের অবস্থা ভাল নেই। সর্ব শরীলে ব্যাথা থাকার পরেও তিনি জীবন-যুদ্ধে কখনে হার মানেনি। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভাঁড়ের এক ঢালায় ঝাল চানাচুর অন্য ঢালায় শুটকী নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন।

চানাচুর ওয়ালা নজরুল ইসলাম জনবাণীকে বলেন, “আমার দুভাগ্য কপাল। আবাদী জমি-জমা নাই। মাত্র ১০ শতক জমিতে ছোট একটি টিনসেট স্ত্রীসহ কোন রকমেই দিন পাড় করছি। ঝাল চানাচুর ও শুটকী বিক্রি করেই ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে মানুষ করেছি। ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। তারা তাদের সংসারে ব্যস্ত। আর এক মাত্র ছেলে বিয়ের পর পর এভাবে বৃদ্ধ বাবা-মাকে একা ফেলে আলদা সংসার গড়বে তা ভাবতে পারিনি বাহে! ছেলে-মেয়ে কেউয়ে খোঁজ খবর নেয় না। মোর দুর-ভাগ্য কপাল বাহে!” 

তিনি জানান, “শরীলটা চায় বিশ্রাম। কিন্তু বিশ্রাম করলে তো ক্ষিদা যায় না। পেটের তাড়নায় কাঁধে ঝাঁল চানাচুর ও শুটকী নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি বিক্রি করে দুই বুড়াবুড়ির ভরণ-পোষণ ও ঔষধপত্র কিনতে কিনতে অবস্থা খারাপ। অনেক সময় ধার-দেনা করেও চলতে হয়। সর্ব শরীলে ব্যাথা। শেষ বয়সে এসেও দু-মুঠো খাবারের জন্য এসব করতে হচ্ছে। যে কোণে দুই স্বামী-স্ত্রীয়ে বয়স্ক ভাতা পাই। বয়স্ক ভাতা আর চানাচুর বিক্রি করে যে দুই টাকা আয় হয় তাই দিয়ে অতিকষ্টে বেঁচে আছি। এক মাত্র থাকার ঘরটিও অবস্থা ভীষণ নাজুক। চাটাইয়ের বেড়া ও টিনের তৈরী ঘরটিও জরাজীর্ণ। গ্রামে বৈদ্যতিক আলোর ব্যবস্থা থাকলেও তিনি তা পাননি। বৈদ্যুতিক লাইন পেতে যে টাকা দিতে হবে তা তার সামর্থ্যের বাইরে। তাই বছরের পর ভচর কুপির আলোতেই রাত কাটান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি পাকা ঘরের প্রত্যাশা করেন নজরুল ইসলাম।”
 
নজরুল ইসলামের স্ত্রী মজিরন বেগম জনবাণীকে বলেন, “আমার স্বামী চানাচুর বিক্রি করে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা রোজগার করে। তাকে দিয়া কোন রকমেই দুই বুড়াবুড়ি খাই। একনা বেটা বিয়ে দিয়েছি। বৌসহ ঢাকায় থাকে। দুই বুড়াবুড়ির খোঁজ খবরও নেয় না। সরকার ভাল থাকুক দুই জনকেই বয়স্ক ভাতা দিয়েছে। কোন রকমে ভাঙ্গাচুরা একটা বাড়ীতে থাকি। টাকা-পয়সা না থাকায় বিদ্যুৎ নিতে পারিনি। কোন রকমেই কুপির আলোয় চলছে জীবন। সরকার থেকে যদি একটা পাঁকা ঘর ও বাড়ীতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিতো খুবই ভাল হতো বাহে!”  

স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল আলিম জনবাণীকে জানান, “নজরুল ইসলাম নব্বই বছর বয়সেও এসে ভাঁড় ঘাড়ে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি অসুস্থ থাকার পরেও রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করে সংসার চালান। তার সৎ কর্মের জন্য তাকে ছালাম জানাই। নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী দুজনেই বয়স্ক ভাতা পান। তবে তার ঘরের অবস্থা ভাল না। আবার বাড়ীতে নেই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। আমি চেষ্টা করবো তারা যেন একটা সরকারি ঘর ও বিদ্যুৎ সেবাটা যেন পায়।”

এ প্রসঙ্গে ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন দাস জনবাণীকে জানান, “দুই স্বামী-স্ত্রী যেহেতু বয়স্ক ভাতা পান এটা খুবই ভাল। তবে সামনের অর্থ বছরে সরকারি ঘরের বরাদ্দ আসলে তাদেরকে ঘর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে তিনি জানিয়েছেন।”

এসএ/