দু'সন্তানের দায়িত্ব নিলে রাস্তায় জন্মনো নবজাতককে দত্তক দিবে পরিবার


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


দু'সন্তানের দায়িত্ব নিলে রাস্তায় জন্মনো নবজাতককে দত্তক দিবে পরিবার

নিহত জাহাঙ্গীরের স্ত্রীর পেটে থাকা ৮ মাসের বাচ্চা পেট ফেটে বের হলেও আল্লাহর রহমতে অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায়। শিশুটির বাবা, মা বোনকে হারিয়ে এখন এতিম। সে জানেও না কে তার বাব-মা। সকলের প্রশ্ন এখন নবজাতকটির শেষ আশ্রয়স্থল হবে কোথায়। 

নিহত জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর আজ চতুর্থ দিন। বসতঘরের পাশেই দাফন করা তিনটি কবরের দিকে অভাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিহত জাহাঙ্গীরের প্রতিবন্ধী বাবা, মা ও সন্তানরা। অঝরে কাদতে কাদতে চোখের পানি যেন কোথায় শুকিয়ে গেছে। নিহত জাহাঙ্গীরের প্রতিবন্ধী বাবা, মা যানে তাদের ছেলে, পুত্রবধু ও নাতি আর কখনো ফেরত আসবেনা। কিন্তু নিহতের সন্তান এবাদত এখনো মনে করে তাদের বাবা,মা, বোন আবার ফেরত আসবে। যখন মানুষের কাছে শুনে তাদের বাব-মা আর কখনও আসবে না তখনই কান্না শুরু করে। আর মোবাইলে থাকা তাদের বাবা,মা বোনের ছবি বের করে সবাইকে দেখায়। নিহতের ঘটনায় এখনো শোকাহত পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী।

নিহত জাহাঙ্গীরের পরিবার চায় নবজাতকসহ দুই ভাই বোনের দায়িত্ব নিলে শিশুটিকে দত্তক দিবেন তারা। নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা-মা শারিরিক প্রতিবন্ধী তাদেরও দেখার কেউ নেই। এই পরিবারকে অনেকেই সাহায্যের কথা বললেও এখনো নিহতের পরিবার কোন ধরনের সহযোগীতা পাননি। নিহতের পরিবারটি অনিশ্চতায় ভুগছেন। পরিবারটির আবেদন কারও সাহায্য নয় চান স্থায়ী সমাধান।
  
সরেজমিন নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কবরের পাশে বসে আহাজারি করছেন জাহাঙ্গীরের মা সুফিয়া বেগম। আর মলিন চোখে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবা-মা-বোনকে যেন খুঁজছিল জাহাঙ্গীর-রত্না দম্পতির মেয়ে জান্নাত ও ছেলে এবাদত। নবজাতকটি আসার কথা ছিলো পরিবারটিতে। তার বদলে তিন তিনটি জিবন লাশ হয়ে ফেরত এলো।

নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু জানান, ‍“আমার ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতিটুকু হাসপাতালে রয়েছে। আমি আমার স্ত্রী দুই জনই প্রতিবন্ধী চলতে পারিনা আরো দুটি নাতি রয়েছে। আমি চিন্তা করেছি আমাদের সকলের যদি কেউ দায়িত্ব নেয় তাহলে নবজাতক নাতিটিকে দত্তক দিবো। আর আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর অনেকেই আশ্বাস দিয়েছে সাহায্যের কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসে নাই।”

তিনি আরও জানান, “থাকার ঘরের জায়গাটুকু ছাড়া আমার নিজের কোন জমিজমা নেই। থাকার ঘরটিও ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। ঘরের চাল ফুটু বৃষ্টি আসলেই পানি পড়ে। দুই ছেলে ছিল তারাও মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। নতুন তিন কবরের পাশে ২০০৪ সালে ট্রাকচাপায় নিহত আমার ছোট ছেলে শামছুল আলমের কবরও রয়েছে। তারও আগে ১৯৯৫ সালে আমার ভাই ফজলুল হকও মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। বাড়ির পাশে সাত কবরের ৫জনই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়।”

নিহত জাহাঙ্গীরের বড় মেয়ে জান্নাত বলেন, “গতকাল রাতে আমার ছোট বোনটিকে হাসপাতাল থেকে দেখে এসেছি। আমার বোনটি অনেক সুন্দর হয়েছে। দত্তকের প্রশ্ন করা হলে সে জানায়, আমার ছোট বোনকে কেউ দত্তক নিলে আমাদের আরও দুই ভাই বোনকে দেখতে হবে। আর আমার ছোট বোনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। তাকে দেখতে চাইলে আমাদের দেখাতে হবে। আমাদের বাবা,মা নেই প্রধানমন্ত্রী আমাদের না দেখলে আমরা কোথায় যাবো। আমার বাবা আমাকে পড়াশোনা করিয়ে অনেক বড় করতে চেয়েছে।”

নিহত জাহাঙ্গীরের বোন মাহমুদা খাতুন জানান, “আমার ভাই জাহাঙ্গীর অনেক পরিশ্রমী ছিল। আমার প্রতিবন্ধী বাবা, মাকে যে দেখতো। তাদের দেখার আর কেউ রইল না। নবজাতক টিকে কেউ দত্তক নিলে আমার ভায়ের আরো দুটি সন্তান রয়েছে তাদের দায়িত্বও নিতে হবে। আমার বাবা-মা প্রতিবন্ধী তাদেরও দেখার কেউ নেই।”

নিহত জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই শরিফ উদ্দিন শিপন জানান, “আমার ভাই মারা গেলেও স্মৃতি হিসেবে নবজাতক শিশুটিকে রেখে গেছে। ভাই নিহতের পর থেকে অনেকেই সাহায্যের কথা বললেও এখনো আমরা কোন সাহায্য সহযোগীতা পাইনি। এই পরিবারটিকে যদি স্থায়ী সমাধান না করা হয় তাহলে বেচে থাকা কষ্ট কর হয়ে যাবে। নবজাতক শিশুটিকে চাচা/চাচি দত্তক দিবে তবে আরও দুটি শিশু আছে তাদের দায়িত্বও নিতে হবে। আর স্থানীয় মঠবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কদ্দুস মন্ডল এই পরিবারটির একবারের জন্যও খোজ খবর নেননি।”

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আক্তারুজ্জামান জনবাণীকে জানান, “ডিসি মহোদয় আমাকে নিহত পরিবারের খোজ খবর নিতে পাঠিয়ে ছিলেন। তাদের আজ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। আর নিহতের মা প্রতিবন্ধী সুফিয়া বেগমকে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। নিহত পরিবারটির খোজ খবর সবসময় অব্যাহত থাকবে। নিহতের পরিবারকে কেউ সাহায্য করতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছে।” 

উল্লেখ্য, গত শনিবার দুপুর ২টায় উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়নের রায়মনি গ্রাম থেকে জাহাঙ্গীর আলম (৪০) তার আট মাসের অন্তসত্তা স্ত্রী ও ছয়  বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য ত্রিশাল পৌর এলাকায় আসেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পারাপারের সময় দ্রুতগামী মালবাহী ময়মনসিংহগামী ঢাকা মেট্রো-ট-২০-৩৫৮০ ট্রাকটি চাপাদেয়। ঘটনা স্থলেই একই পরিবারের তিন জন নিহত হয়। অন্তসত্তা রতœা বেগমের পেটে থাকা নবজাতক শিশু চাপ খেয়ে পেট ফেটে রাস্তায় প্রসব হয়। নবজাতক মেয়ে বাচ্চাটিকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে  প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যায়। পওে নবজাতক বাচ্চাটিকে  ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজ্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি  করা হয়। নবজাতক শিশুটি বর্তমানে ময়মনসিংহ নগরীর লাবীব প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

এসএ/