সাংবাদিক রুবেল হত্যার জট খোলেনি, নিরাপত্তাহীনতায় কুষ্টিয়ার সাংবাদিকরা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


সাংবাদিক রুবেল হত্যার জট খোলেনি, নিরাপত্তাহীনতায় কুষ্টিয়ার সাংবাদিকরা

পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে। আর সে কারণে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন মূলত তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি তাই সারা বিশ্বেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তার উল্টো। সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক হত্যার ঘটনা সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি আবারো আলোচনায় নিয়ে এসেছে। ৯ দিন পেরিয়ে গেলেও সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেল হত্যার জট খুলতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। 

সর্বশেষ সন্দেহভাজন দুইজন গ্রেফতার হলেও হত্যার কারণ বা কারা জড়িত, সে ব্যাপারে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। এতে ক্ষুদ্ধ হয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। 

নিহত হাসিবুর রহমান রুবেল কুষ্টিয়া জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, একটি আঞ্চলিক পত্রিকার সম্পাদক ও একটি জাতীয় পত্রিকার কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ঠিকাদার ছিলেন। তিনি কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এ ব্লক এলাকার মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে।

গতকাল শনিবার কুষ্টিয়ায় সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেল হত্যায় জড়িত সন্দেহে আটক দুজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে তদন্তকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকার মৃত হামিদ মোল্লার ছেলে কাজী সোহান শরিফ (৪০)। সোহান হত্যার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি। তিনি নিজেও একজন সংবাদকর্মী। অন্যজন একই এলাকার  মৃত খন্দকার হারুন উর রশিদের ছেলে খন্দকার আশিকুর রহমান জুয়েল (৩৫)। 

এ তথ্য জানান র‌্যাব ১২ কুষ্টিয়া ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার ইলিয়াস খান।

তিনি জানান, একজন সাংবাদিক হত্যার ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব আসামীদের গ্রেফতারে উদ্যোগী হয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় সন্দেহভাজন দুইজনকে গ্রেফতার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পাবনা নৌ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, এর বেশি র‌্যাব বিস্তারিত কিছু জানাইনি। 

এদিকে সাংবাদিক রুবেল হত্যায় মূল আসামী গ্রেফতারের দাবীতে সোমবার সকাল ১১টায় পাঁচ রাস্তার মোড়ে সর্বস্তরের সাংবাদিকদের আয়োজনে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে। 

কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, সাংবাদিক রুবেলের মরদেহ উদ্ধারের পরের দিন কুমারখালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের পরিবার। মামলা তদন্তের দায়িত্বে আছেন নৌ পুলিশ।

কুষ্টিয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাংবাদিক রুবেল হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশ ব্যাপকভাবে কাজ করছে। খুব শ্রীঘ্রই সবকিছু উন্মোচন করা সম্ভব হবে।

জানা গেছে, ৩ জুলাই রাত ৯টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের সিঙ্গার মোড়ে পত্রিকা অফিসে ছিলেন হাসিবুর। তখন মুঠোফোনে একটি কল পেয়ে অফিস থেকে বের হয়ে যান। এর পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তার মুঠোফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তার পরিবার। এর চার দিন পর ৭ জুলাই দুপুরে কুমারখালী পৌরসভার তেবাড়িয়া এলাকায় গড়াই নদের নির্মাণাধীন গোলাম কিবরিয়া সেতুর নিচ থেকে হাসিবুরের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গত ৮ জুলাই শুক্রবার রাতে হাসিবুর রহমানের চাচা মিজানুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে কুমারখালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

এদিকে হাসিবুর হত্যার প্রতিবাদে এবং হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে কুষ্টিয়ায় আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার(১৪ জুলাই) সাংবাদিকেরা কুষ্টিয়া পুলিশ সুপারের কার্যালয় ঘেরাও করেন। এর আগে বুধবারও একই দাবিতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করেছিলেন সাংবাদিকেরা। রুবেল হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করেন এডিটরস ফোরামের নেতৃবৃন্দ। 

এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকেরা কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় মাহবুব উল আলম হানিফ তাদেরকে স্থানীয় পত্রিকার প্রকাশনা চলমান রেখে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন এবং রুবেল হত্যা মামলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান।

জনগণের জন্য নিয়োজিত এই পেশাজীবীদের উপর কেন হামলা হয় এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় দৈনিকের সম্পাদক মাহাবুব রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তার কথায়, পেশাগতভাবেই সাংবাদিকরা দমন-নিপীড়নের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরেন। আর এতে সংবাদ যাদের বিপক্ষে যায় তারা ক্ষুব্ধ হন। 

তিনি জানান, সাংবাদিক রুবেল হত্যা ঘটনা কুষ্টিয়ার সাংবাদিকদের ভাবিয়ে তুলেছে। সাংবাদিকরা এক প্রকার পেশাগত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।”

প্রসঙ্গে সাংবাদিক ড. আমানুর আমান বলেন, ‘‘অপকর্ম যেন কখনো প্রকাশিত না হয় সে পথটি নিশ্চিত করতেই সাংবাদিকদের উপর হামলা হয়। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলার ইতিহাস নতুন নয়। এক্ষেত্রে নতুন বিষয়টি হলো যে, সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা বাড়ছে। সাংবাদিক রুবেলের হত্যা নিয়ে প্রশাসনের কর্মকান্ড সম্পর্কে কিছু বলার নেই। প্রশাসন হারানো মোবাইল ও বিড়াল উদ্ধার করে বাহবা নিচ্ছে। অথচ একজন মানুষ নিখোঁজ ও হত্যা হওয়ার পরও তদন্তে কোন অগ্রগতি নেই। এখানে প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে মফস্বল সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্বে চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।”

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বর্তমানে সাংবাদিকতার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো মফস্বল সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার বহুমুখী বিস্তারের ফলে সাংবাদিকদের উপর হামলার সংখ্যাও বাড়ছে।”

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন সিনিয়র সাংবাদিক নুর আলম দুলাল। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‍“ঐক্যবদ্ধ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়েই সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে আইনগত নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি সাংবাদিকতা চর্চায়ও পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন।”

এসএ/