১৪ দিনেও ফলশূন্য সাংবাদিক রুবেল হত্যা মামলার ‌‘ছায়া তদন্ত’


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


১৪ দিনেও ফলশূন্য সাংবাদিক রুবেল হত্যা মামলার ‌‘ছায়া তদন্ত’

অধরাই থেকে যাচ্ছে সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেল হত্যাকান্ডের ক্লু। ১৪ দিন পার হয়ে গেলেও এই হত্যা মামলার তদন্ত আলোর মুখ দেখিনি। মামলা তদন্ত করছে নৌ-পুলিশ। সেই সাথে জেলা পুলিশ ও র‌্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে বলে দাবি করেছে। তদন্ত ও ছায়া তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, খুবই গুরুত্বের সঙ্গে ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি এই হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।

তবে আইন বিশেষজ্ঞদের মতে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলায় তদন্তকারী সংস্থাকে তড়িৎ অ্যাকশনে যেতে হয়, না হলে আলামত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া ছায়া তদন্ত বলে কোন শব্দ আইনি অভিধানে পরিলক্ষিত হয় না। আর সেটার ব্যবহার থাকলেও সেই সংস্থার দায়বদ্ধতা নেই। তাই তদন্ত তাদের স্বদিচ্ছার উপর নির্ভর করে। 

এরই মধ্যে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে দুইজনকে র‌্যাব গ্রেফতার করলেও সন্তুষ্ট নয় কুষ্টিয়ার সাংবাদিকরা। তারা নির্মম এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত প্রকৃত খুনীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে দফায় দফায় প্রতিবাদ সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন। এরই অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার বেলা ১১ টায় কুষ্টিয়া প্রেসক্লাব চত্বরে থেকে কালো ব্যাচ ধারণ করে মৌন মিছিল করেন সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। একই দাবিতে আগামী ২৪ জুলাই রবিবার অনশন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশে হাসিবুর হত্যাকান্ড নিয়ে প্রশাসনের ভূমিকাকে রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক নেতারা। তারা প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। 

মামলার তদন্তকারী সংস্থা পাবনা নৌ-পুলিশের অফিসার ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা জনবাণীকে বলেন, “লাশ নৌ-পুলিশের সীমানার মধ্যে উদ্ধার হওয়ায় নৌ-পুলিশ মামলার তদন্ত করছে। গতকাল বুধবার গ্রেফতার দুইজনকে আদালতে হাজির করে ১০দিনের রিমান্ড আবেদন করলে তা নামন্জুর ক‌রে ৪ দিন জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন বিচারক।” 

তিনি বলেন, “মামলার মুল রহস্য উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেফতারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।” 

প্রথম থেকেই রুবেল হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছেন কুষ্টিয়া এডিটরস ফোরামের সভাপতি মজিবুল শেখ। 

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তথ্য প্রযুক্তির এই দিনে একজন নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়াটাই ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা। রুবেল নিখোঁজ ও হত্যার ঘটনায় নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ করছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদী হাসান। তথ্য ও উপাত্তের খাতিরে ঘটনার পর্যবেক্ষণ করেছেন খুব কাছ থেকে। 

তিনি আরো বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম থেকেই মামলাটি গুরুত্বসহকারে নেননি। তদন্তে হার্ড লাইনে না যাওয়ায় হত্যা রহস্য উদঘাটন আলোর মুখ দেখেনি। তাছাড়া নৌ-পুলিশকে সাংবাদিক রুবেল হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদেরকে অন্য জেলা থেকে এসে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এতে তদন্ত কাজ ধীরগতিতে চলার সম্ভাবনা থাকে।”

মামলা হস্তান্তরের বিষয়ে করণীয় কি আছে?-এমন প্রশ্নের জবাবে তৌহিদী হাসান বলেন, মামলার তদন্তকাজ অন্য সংস্থার কাছে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দুই ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যায়। একটি বাদীর নারাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে। আরেকটি হলো চাঞ্চল্যকর মামলা বিবেচনা ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতায় আলোচনা সাপেক্ষে। তাবে নিয়মনুযায়ী তা একমাস পরে সম্ভব।” 

মামলার অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা-এমন এক প্রশ্নের জবাবে মামলার বাদী মিজানুর রহমান বলেন, “মামলার তদন্ত পিবিআই’র কাছে হস্তান্তরের জন্য আবেদন করা হয়েছে। যেহেতু গ্রেফতারকৃত দুইজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত সেহেতু এখন হস্তান্তর সম্ভব হয়নি।” 

সাংবাদিক রুবেল হত্যা মামলা নিয়ে জনবাণীর সাথে কথা হয় কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অ‌ধ্যাপক ড.জহুরুল ইসলামের সাথে। 

‘এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত আরো বেগবান কিভাবে করা যায়’ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “তদন্তে সরকারের অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে থাকে। সেক্ষেত্রে যে সংস্থা তদন্ত কার্যক্রমে অধিক পারদর্শী তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। যেমন র‌্যাব পিবিআই, ডিবি ইত্যাদি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তক্রমেই এটা হতে পারে।”

“মামলা থানায় দায়ের হলেও তদন্ত করছে  নৌ-পুলিশ” এক্ষেত্রে মামলার ধীরগতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নদীতে লাশ পাওয়া গেছে সেই বিবেচনায় নৌ পুলিশকে তদন্ত দেওয়া খুব বুদ্ধিদীপ্ত কাজ নয়। এতে সাধারণ জনগণের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। বরং অপরাধ তদন্তে সরকারের আরো অনেক পারদর্শী সংস্থা রয়েছে তাদের হাতে দেওয়াটাই উত্তম।” 

“যেসব সংস্থা ছায়া তদন্ত করছে তারা কতটুকু সহযোগিতা করতে পারবে” প্রশ্নের উত্তরে ড.জহুরুল ইসলাম বলেন, “ছায়া তদন্ত বলে কোন শব্দ আইনি অভিধানে পরিলক্ষিত হয় না। সাধারণত এটাকে প্রতীকী তদন্ত বলা যায়, যার আইনি ভিত্তি নাই। এ ধরনের জটিল এবং চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটনে প্রতীকী তদন্ত সাধারণ জনগণের ধারণায় একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আইনের ভাষায় একটি কথা আছে ‘আপনি যে শুধু ন্যায়বিচার করছেন সেটা মুখে বললেই হবে না, আপনাকে সেটা করে দেখাতে হবে।” 

‘সাংবাদিকদের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে’ প্রশ্নে তিনি মন্তব্য করে বলেন, “ব্যর্থতা আপেক্ষিক ব্যাপার। এখনই ব্যর্থ বলার পরিস্থিতি আসেনি। তবে নিরপেক্ষ তদন্ত বা কার্যকরী তদন্ত পরিলক্ষিত হলে সাধারণ জনতার এ ধারণাটি পরিবর্তন হবে। এই ধারণা পরিবর্তনের দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রয়েছে।” 

থানা সুত্রে জানা গেছে, গত ৭ জুলাই দুপুরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌরসভার তেবাড়িয়া এলাকায় গড়াই নদীতে নির্মাণাধীন গোলাম কিবরিয়া সেতুর নিচ থেকে রুবেলের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ৩ জুলাই রাত নয়টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের সিঙ্গার মোড়ে পত্রিকা অফিসে ছিলেন রুবেল। তখন মুঠোফোনে একটি কল পেয়ে অফিস থেকে বের হয়ে যান। এর পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি। তার মুঠোফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। লাশ উদ্ধারের পরের দিন ৮ জুলাই রাতে হাসিবুর রহমানের চাচা মিজানুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে কুমারখালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। 

জানা গেছে, নদী থেকে লাশ উদ্ধার হওয়ায় রুবেল হত্যা মামলার তদন্ত করছে নৌ-পুলিশ। কিন্তু তাড়াতাড়ি মামলার রহস্য উদঘাটনে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ ও র‌্যাব ছায়া তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জেলা বিশেষ শাখা) ফরহাদ হোসেন খানের নেতৃত্বে একটি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। পুলিশের দাবি বোর্ডের সদস্যরা রাতদিন ২৪ ঘণ্টা এই হত্যাকান্ড নিয়ে কাজ করছেন। 

এদিকে এক সপ্তাহ ধরে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্যেই মঙ্গলবার(১৯ জুলাই) রুবেল হত্যার ১২ দিন পর জেলা পুলিশ সুপার খাইরুল আলম তাঁর কার্যালয়ে আন্দোলনরত সাংবাদিকদের ডেকে বৈঠক করেন। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে কুষ্টিয়া জেলা এডিটরস ফোরামের সভাপতি মজিবুল শেখ, কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামান ডাবলু, সাংবাদিক ইউনিয়ন কুষ্টিয়ার সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব, কুষ্টিয়ার সাংবাদিক অধিকার ফোরামের সভাপতি নূর আলম দুলাল, হাসান আলী, সোহেল রানা, গোলাম মওলা, শরীফ বিশ্বাস, এস এম জুবায়েদ রিপন, এস এম রাশেদ, তৌহিদী হাসানসহ জেলার শীর্ষ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

বৈঠকে পুলিশ সুপার খাইরুল আলম আশ্বাস দিয়ে বলেন, “জেলা পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। এই হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তাঁরা বেশ কয়েকটি সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। সূত্র ধরে অনেক দূর আগানো হয়েছে। তবে তিনি এই সময়ের মধ্যে যেন পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভাবা না হয় সেদিকটাও সাংবাদিকদের বিবেচনার সহিত দেখতে বলেন। রুবেল হত্যা মামলায় সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করেন।”  

নিহত হাসিবুর কুষ্টিয়া জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় দৈনিক কুষ্টিয়ার খবর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও দৈনিক আমাদের নতুন সময় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি ঠিকাদারি করতেন। হাসিবুর কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং এ ব্লক এলাকার মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে।

এসএ/