দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
নতুন কৌশলে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ
আজাহারুল ইসলাম সুজন
প্রকাশ: ০৭:৪১ পূর্বাহ্ন, ৩১শে অক্টোবর ২০২২

***নজর রাখছে জোট-মহাজোটের মেরুকরণেও
***ডিসেম্বরের মধ্যে মূল দলসহ সকল সংগঠনের সম্মেলন
***নতুন বছরের শুরু থেকেই ৬৪ জেলায় নির্বাচনি জনসভা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। মাঠে তৎপরতা বাড়িছে বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলগুলো। সরকারবিরোধী প্লাটফর্মে ছোট দলগুলো জোটবদ্ধ হচ্ছে। ভোটকেন্দ্রিক উত্তাপ ক্রমশ ছড়াচ্ছে রাজপথে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলকে আপাতদৃষ্টিতে চুপচাপ মনে হচ্ছে। সংগঠনকে ঢেলে সাজানো, অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিরসন, ইশতেহার তৈরিসহ ছয় বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজে নেমে পড়েছে ক্ষমতাসীনরা। নজর রাখছে জোট-মহাজোটের মেরুকরণেও। দৃশ্যমান কোনও কর্মসূচিতে নেই ক্ষমতার অংশীদার জোটও। অন্যদিকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠনসহ একগুচ্ছ দাবিতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। এই পরিস্থিতিতে টানা তিন মেয়াদের শাসক দল আওয়ামী লীগ ভোটের হিসাব কষে ভেতরে ভেতরে নতুন কৌশল ঠিক করছে, যা নিয়ে আগামী বছরের শুরু থেকে মাঠে নামবে তারা সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।
সূত্রমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এক্ষেত্রে ছয় বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে ইতোমধ্যে কাজে নেমে পড়েছে দলটি। আওয়ামী লীগ এখন ব্যস্ত সময় পার করছে দল, অঙ্গ ও সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো গোছানোর কাজে। আগামী মাস তথা নভেম্বর ও ডিসেম্বরের মধ্যে মূল দলসহ সকল সংগঠনের জাতীয় সম্মেলন শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে এই দুই মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নড়াইল ও যশোরসহ আরও কয়েকটি শহরে বড় জনসভা করা হবে। এসব কর্মসূচিতে বিশাল শোডাউন করা হবে, যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে অংশগ্রহন করবেন।
সম্মেলনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনকে ঢেলে সাজানো, অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিরসন, ইশতেহার তৈরি, বিএনপি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ, জোটের মেরুকরণ ও দলীয় প্রার্থী বাছাই। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশের পরই দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।
গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকের ফাঁকে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, আগামী ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে জনসভা করবে আওয়ামী লীগ। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন নিজ বাসায় সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় তিনি বলেছেন, জনসমাগম কাকে বলে তা শনিবার (২৯ অক্টোবর) থেকে বিএনপিকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এই শনিবার ছিল ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। এতে বিএনপি মহাসচিবকে উদ্দেশ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এখানে তো শেখ হাসিনা নাই। দেখাবো, পলোগ্রাউন্ডে দেখাবো। সেখানে ১০ লাখ লোকের সমাগম হবে। শেখ হাসিনা যাবে। আপনারা ১০ লাখ মুখে বলবেন, আমরা বাস্তবে দেখাবো। আপনাদেরটা বাস্তবে সত্য নয়।'
শুক্রবারের বৈঠকে উপস্থিত থাকা আওয়ামী লীগের অন্তত চারজন নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছি। যেখানে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি আছে সম্মেলনের মাধ্যমে সেগুলো ঢেলে সাজানোর কাজ করছি। দলের অভ্যন্তরে কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধানের চেষ্টা চলছে। চট্টগ্রামের জনসভার দিনক্ষণ ঠিক করা হলেও নড়াইল ও যশোরের তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই দুই জেলায় সকালে সরকারি কর্মসূচি শেষ করে বিকালে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভাষণ দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া আরও দুই-তিনটি জেলায় একই ধরণের কর্মসূচি নেওয়া হতে পারে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। আগামী ১১ নভেম্বর যুবলীগের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুব মহাসমাবেশে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিবেন শেখ হাসিনা। ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ করা হবে, তাতেও বক্তব্য রাখতে পারেন তিনি।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে আওয়ামী লীগ। বিএনপি একের পর এক বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করে রাজধানী পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে। ডিসেম্বরে ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিতে পারে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে কাছাকাছি সময়ে পাল্টা জনসভা করবে আওয়ামী লীগ। তবে জানুয়ারি থেকে বিরোধীদের আন্দোলনে রাজপথে ব্যাপক উত্তাপ ছড়াতে পারে, তার মধ্যে সম্মেলন শেষ করে মাঠে নামার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে ক্ষমতাসীনরা। আর বিরোধীদের আন্দোলন সহিংস রূপ নিলে সরকার কঠোর অবস্থানে থেকে তা প্রতিহত করবে। সে ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে বাধা দেওয়া হবে না। তবে অশান্তি সৃষ্টি করলে শক্ত হাতে দমন করা হবে। যারা খুনের সঙ্গে জড়িত, অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের ধরতে হেেব । তাদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না।'
আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন আগামী ২৪ ডিসেম্বর একদিনেই সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৈঠকে। তার আগেই দলের অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সম্মেলন শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে বসে সম্মেলন সূচি চূড়ান্ত করতে ওবায়দুল কাদেররে বলেছেন তিনি। সম্মেলন শেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সানে রেখে নতুন কৌশল নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামবে আওয়ামী লীগ।
জানা গেছে, এই কৌশলের বিষয়ে শুক্রবারে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে নীতিনির্ধারকদের মাঝে আলোচনা হয়। এর প্রেক্ষিতে দলটির প্রধান শেখ হাসিনা প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, নতুন বছরের শুরু থেকেই দেশের ৬৪ জেলায় নির্বাচনি জনসভা শুরু করতে হবে। এসব কর্মসূচিতে সশরীরে হাজির হবেন তিনি। এ ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত জেলাগুলোর পাশাপাশি যেসব জেলায় সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা যাননি, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জেলা ও সংসদীয় আসনভিত্তিক প্রচারপত্র করে মানুষের মাঝে বিলি করা হবে। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে তৈরি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন এবং স্থানীয়ভাবে সভা-সমাবেশ করে জনসম্পৃক্ত থাকতে নৌকার সংসদ সদস্যদের বলা হবে শিগগিরই। সংসদ সদস্যদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে শিগগিরই সংসদীয় দলের সভা আহ্বান করা হবে। সেখানে ভোটের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সতর্ক বার্তাও দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। বিভিন্নভাবে পরিচালিত জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে ভোটে জেতার মতো প্রার্থীদের আগামীতে মনোনয়ন দেওয়া এবং তা না মেনে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও থাকবে এমপিদের উদ্দেশে।
ধারনা করা হচ্ছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দুর্নীতি ও অনিয়ম, আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মতো বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসার জন্য তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছেও বার্তা পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার নির্দেশও দেওয়া হবে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকা জেলাগুলোয় সম্মেলন করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এ ক্ষেত্রে দুর্দিনের কাণ্ডারি ও ত্যাগী নেতাদের পদায়ন করতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটকে আবারও সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সেজন্য শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি মতপার্থক্য থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত গঠনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে, রাজপথে আছি, থাকব এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। যারা রাজপথ নতুন করে দখল করার কথা বলছে তাদের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করার দরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃণমূলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। দ্বন্দ্বে জর্জরিত প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলা। কোথাও জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বিরোধ। কোথাও বিরোধ স্থানীয় এমপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের। রাজনৈতিক পদ-পদবি ছাড়াও স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় টেন্ডার, দখল, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণেই এই বিরোধ রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মধ্যে ৫৮টি অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আটজন নিহত ও ৮০২ জন আহত হয়েছেন। নির্বাচনে আগে এসব সমস্যা সমাধান করতে চায় আওয়ামী লীগ। দলটির আট সাংগঠনিক টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নিজেদের বিরোধ মেটাতে মাঠে নেমেছেন। বিরোধপূর্ণ জেলার নেতাদের ডেকে সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দিচ্ছেন। করছেন বর্থিত সভা। নির্দেশমতো দ্রুত বিরোধ নিরসন না করলে হাইকমান্ডের কাছে পরবর্তী করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হবে।
দলটির নেতারা বলছেন, দলীয় সভাপতির নির্দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সব অভ্যন্তরীণ সমস্যা মিটিয়ে তৃণমূল পর্যন্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ এবং আরও শক্তিশালী করতে তারা মাঠে নেমেছেন।
বিজ্ঞাপন
পাঠকপ্রিয়
আরও পড়ুন

শহীদদের দলীয়করণ করলে তাদের অবমূল্যায়ন করা হবে: ডা. জাহিদ হোসেন

খেলাধুলা ও ক্রীড়াঙ্গন রাজনীতি মুক্ত থাকা উচিত : মির্জা ফখরুল

তারেক রহমানের দেশে ফেরার নেপথ্যে নিরাপত্তা ও নির্বাচন

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে সরকারকে তারেক রহমানের আহ্বান
