চালু হচ্ছে 'এনইআইআর', অবৈধ মোবাইল সেটে বন্ধ হবে নেটওয়ার্ক

আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে চলেছে। ওই দিন থেকে মোবাইল ফোনের জন্য জাতীয় পর্যায়ের ‘ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার’ (এনইআইআর) সিস্টেম চালু হতে যাচ্ছে। এই পদ্ধতি চালু হলে দেশের সকল মোবাইল ফোনের আইএমইআই (IMEI) নম্বর জাতীয় ডেটাবেইজে যুক্ত হবে এবং এর মাধ্যমে অবৈধ বা আনঅফিসিয়াল পথে আসা কোনো মোবাইল সেট বাংলাদেশের নেটওয়ার্কে আর কাজ করবে না।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ইতোমধ্যে এই জাতীয় ডিভাইস শনাক্তকরণ ব্যবস্থা চালুর প্রস্তুতি নিয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের মোবাইল ফোনের বাজারে অবৈধ বা আনঅফিসিয়াল পথে আসা সেটের ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে।
বিটিআরসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব ফোন শুধু সরকারের রাজস্ব ক্ষতি করছে না, বরং এ ধরনের রেজিস্ট্রেশনবিহীন ডিভাইস ব্যবহার করে নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে যেতে সহায়ক হচ্ছে। এই পরিস্থিতি রোধে এবং মোবাইল নেটওয়ার্ককে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত ও নিরাপদ রাখতে এনইআইআর চালু করা হচ্ছে।
বিটিআরসি'র স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আমিনুল হক, নিশ্চিত করেছেন যে এই সিস্টেম তৈরির মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কে অবৈধ ও চোরাই হ্যান্ডসেটের ব্যবহার বন্ধ করা।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও জানান, এর মাধ্যমে মোবাইল ফোন ক্লোনিং ও চুরি প্রতিরোধ হবে, স্থানীয় মোবাইল ফোন শিল্প সুরক্ষা পাবে, সরকারের রাজস্ব ক্ষতি বন্ধ হবে এবং গ্রাহকদের ব্যবহৃত ফোনের বৈধতা যাচাইয়ের কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এছাড়া, এটি টেলিযোগাযোগ সেবার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
বিটিআরসি জানিয়েছে, বর্তমানে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে সচল সব বৈধ বা অবৈধভাবে আমদানিকৃত মোবাইল হ্যান্ডসেট ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হয়ে যাবে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পর নতুন যেসব ফোন নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে, সেগুলো প্রথমে অস্থায়ীভাবে সচল থাকবে। এনইআইআর সিস্টেম তখন এর বৈধতা যাচাই করবে। যদি ফোনটি বৈধ হয়, তবে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হয়ে সচল থাকবে। তবে, অবৈধ ফোন হলে গ্রাহককে এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হবে এবং একমাসের সময় দেওয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে ফোনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
বিদেশ থেকে ব্যক্তিগতভাবে কেনা বা উপহার পাওয়া মোবাইল হ্যান্ডসেটের জন্য বিশেষ নিবন্ধনের সুযোগ থাকবে। এই ডিভাইসগুলো প্রাথমিকভাবে নেটওয়ার্কে সচল থাকবে এবং গ্রাহককে এসএমএসের মাধ্যমে ৩০ দিনের মধ্যে অনলাইনে প্রয়োজনীয় তথ্য দাখিল করতে বলা হবে।
নিবন্ধনের জন্য গ্রাহককে (neir.btrc.gov.bd) ওয়েবসাইটে গিয়ে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এরপর 'Special Registration' সেকশনে গিয়ে হ্যান্ডসেটের IMEI নম্বর ও প্রমাণপত্র (যেমন পাসপোর্ট, ভিসা, ক্রয় রশিদ, কাস্টমস রশিদ ইত্যাদি) আপলোড করতে হবে। মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টার থেকেও এই সেবা নেওয়া যাবে। বিদ্যমান ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি নিজের ব্যবহৃত একটি বাদে সর্বোচ্চ একটি ফোন বিনা শুল্কে এবং আরও একটি ফোন শুল্ক প্রদান সাপেক্ষে আনতে পারবেন।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের নিবন্ধনের অবস্থা জানতে চাইলে সহজেই যাচাই করা যাবে। ডায়াল করুন *১৬১৬১# নম্বরে। প্রেরণ করুন ১৫ ডিজিটের IMEI নম্বর লিখে। ফিরতি মেসেজে হ্যান্ডসেটটির নিবন্ধন অবস্থা জানানো হবে।
এছাড়াও, নতুন ফোন কেনার আগে বৈধতা যাচাই করতে ফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করতে হবে- KYD <space> 15 digit IMEI এবং পাঠাতে হবে ১৬০০২ নম্বরে। বৈধ হ্যান্ডসেট হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনইআইআর সিস্টেমে নিবন্ধিত হয়ে যাবে।
বিটিআরসি জানিয়েছে, ১৬ ডিসেম্বরের পর কোনো গ্রাহক নিজের হ্যান্ডসেট বিক্রি বা হস্তান্তর করতে চাইলে আগে 'ডি-রেজিস্ট্রেশন' করা বাধ্যতামূলক। এটি Citizen Portal, MNO Portal, মোবাইল অ্যাপস বা USSD চ্যানেল (*১৬১৬১#) এর মাধ্যমে করা যাবে।
বিজ্ঞাপন
এছাড়াও, এই সিস্টেম চালু হওয়ার ফলে গ্রাহকের মোবাইল চুরি হলে বা হারালে তা সহজেই ব্লক করা যাবে। এনইআইআর পোর্টাল, মোবাইল অ্যাপ বা অপারেটরের কাস্টমার সেন্টার থেকে ফোন লক বা আনলক করা যাবে। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও গ্রাহকরা USSD চ্যানেল বা অপারেটরের ১২১ নম্বরে কল করে এই সেবা নিতে পারবেন।
সম্প্রতি বিটিআরসি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, জানান, অবৈধ হ্যান্ডসেটের কারণে প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, এনইআইআর কেবল প্রযুক্তিগত সুবিধা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ও গ্রাহক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং সিমের মাধ্যমে প্রতারণা, আর্থিক লেনদেন জালিয়াতি কমিয়ে আনবে।
বিজ্ঞাপন
বিটিআরসি চেয়ারম্যান, মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী (অব.), বলেন যে এনইআইআর চালু হলে মোবাইল হ্যান্ডসেট এবং সিম সংক্রান্ত অপরাধ সহজে সনাক্ত করা যাবে। চোরাই ও রিফাবরিসড হ্যান্ডসেট বাজারে থাকায় ফোনের দাম বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এনইআইআর চালু হলে দেশীয় ১৮টি মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে হ্যান্ডসেট বিক্রি করতে পারবে।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইওবি) সভাপতি জাকারিয়া শহীদ এবং অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর্স অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব লে. কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জুলফিকার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এনইআইআর চালুর মাধ্যমে বৈধ আমদানিকারক ও স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ পাবে, যা প্রযুক্তি খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।









