নারী দিবসের তাৎপর্য এবং ইসলামে নারীর মর্যাদা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


নারী দিবসের তাৎপর্য এবং ইসলামে নারীর মর্যাদা

এই দিবসটি উদ্‌যাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়ঃ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

এই বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম হল “choose to challenge”! জীবনের প্রতিধাপে, ঘরে হোক বা বাইরে নানান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি মহিলারা৷ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সারা বিশ্বের মহিলাদের কাছে এখনও উদ্বেগের বিষয়৷ কিছু সুরক্ষা সতর্কতা (Women Safety) কর্মক্ষেত্রে, বাজারে বা একা থাকাকালীন যে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার বিরুদ্ধে নিরাপদে রাখতে পারে মহিলাদের।

১৫শ বছর আগেই ইসলাম নারী ও পুরুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। জাহেলি যুগে নারী জাতির কোনো মর্যাদা ছিল না। সে সময় নারীরা ছিল নিপীড়িত-নির্যাতিত ও অবহেলিত। নারীদের সঙ্গে করা হতো পশুর মতো আচরণ। পুরো নারী সত্ত্বাকে পরিবার,সমাজ ও বংশের জন্য অভিশাপ মনে করা হত। কন্যা সন্তান জন্মকে অসম্মান ও অপমানকর মনে করা হতো। শুধু কি তাই? নারীর অধিকার বলতে কিছুই ছিল না সমাজে। নারীরা যেমন মর্যাদা ও সম্মান পেতো না, ঠিক তেমনি তাদের ন্যায্য অধিকার (মিরাস) উত্তরাধিকারী পেতো না। কোন সম্পদের মালিকানাও লাভ করতে পারতো না। এমনকি একজন মানুষ হিসেবে যে অধিকারগুলো লাভ, তার কোনটিই বলতে গেলে নারীদের দেওয়া হত না। তাদের ইজ্জত-আব্রত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ছিল নৈমত্তিক ব্যাপার। সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান ছিল নিম্নে। ছিল না স্বীকৃতি। বৌদ্ধ সমাজে নারীদেরকে নিছক বিলাসিতার উপকরণ মনে করা হতো। এ ধর্মে নারী হচ্ছে ভোগের বস্তু এবং মানবতার নির্মাণ লাভের জন্য বিঘ্ন স্বরূপ। ইয়াহুদি ধর্ম মতে নারীদেরকে সকল পাপের উৎসমূল মনে করা হত। সেই তিমিরাচ্ছন্ন কলুষিত সমাজকে নিষ্কলুষ করার জন্য বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা. সত্যের বাণী নিয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরার বুকে আবির্ভূত হলেন। আল্লাহ ও তদীয় রাসুল সা. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হল নারীর অধিকার ও মর্যাদা। বিশ্বনবীর কল্যাণে মহিয়সী নারী মর্যাদা পেয়েছে মাতা হিসেবে। পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বামীর সংসারে স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। নারী তার বৈবাহিক জীবনে খাদ্য উপার্জনের চিন্তা হতে মুক্ত হয়েছে। তেমনিভাবে সমাজের সসর্বস্তরের নারীর যথার্থ মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান ও যথাযথ অধিকার দিয়েছে। নারীর মর্যাদা বলতে কী বুঝায়? মর্যাদা মানে পদ ও সম্মান। কারও পদ বা মর্যাদার অর্থ হচ্ছে যথাযথভাবে তার প্রাপ্য প্রদান করা। আর প্রাপ্য বলতে তাদের অধিকার স্বীকার করা, কর্তব্যের যথাযথ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সামাজিক জীবনে তার অবদানসমুহের মুল্যায়নকে বুঝায়। নারীর মর্যাদা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তার ন্যায্য অধিকার সঠিকভাবে আদায় করা, তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঠিক ব্যাখ্যা ও তার অবদানের যথাযথ মুল্যায়ন করা। ইসলাম মানব প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবন বিধান। এখানে মানুষকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। নারী-পুরুষ সবাই মানুষ হিসেবে এই মর্যাদার অংশীদার। মানবকুল নারী-পুরুষ দ্বারা গঠিত। নারী থেকে পুরুষ, পুরুষ থেকে নারী কোনভাবেই আলাদা করার সুযোগ নেই। এই পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্ব থাকতে হলে নারী-পুরুষের যৌথ উপস্থিতি অপরিহার্য। নারীর কাছে পুরুষ, আর পুরুষের কাছে নারী ঋণী। এই দুই এর কোন একজনকে বাদ দিয়ে মানব জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। একদিকে যেমন একজনকে ছাড়া আরেকজনের অস্তিত্বই বিপন্ন, অন্যদিকে একজনের কাছে আরেকজন অপরিহার্যভাবে ঋণী। সুতরাং ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, সব জীবনেই একজনের কাছে আরেকজন দায়বদ্ধ। মা-বাবা বিশেষ কোন দিবসের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। তারা তো প্রতিদিনের মত। মা চাঁদের আলোরমত আর বাবা সূর্যের আলোরমত দরকারী। মুসলিম সভ্যতায় পুরুষের চেয়ে নারীর মর্যাদা, মুল্যায়ন, অধিকার কোনক্রমেই কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা পুরুষের চেয়েও বেশি। স্ত্রী হিসেবে একজন নারীর জন্য ইসলাম মানবিক অধিকার নিশ্চিত করেছে । পুরুষের জন্য অপরিহার্য করা হয়েছে স্ত্রীর মোহরানা আদায় । এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, তোমরা স্ত্রীদেরকে তার পারিবারিক জীবনে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশি মনে। সুরা নিসা: ৪। আল্লাহর রাসুল সা. এরশাদ করেন, যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান আছে যাদের সে লালন পালন করে এবং তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করে, তার জন্য অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব। ইসলাম নারীকে সমধিকার নয় বরং পুরুষের চেয়ে বেশি অধিকার প্রদান করেছে।

পরিশেষে,শুধু বছরে একবার নারীদের প্রতি দরদী না হয়ে সারা বছর নারীদের যথাযথ প্রাপ্য আদায়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হওয়া জরুরি।

লেখক: মোঃ লোমান হাকিম, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।  

এসএ/