জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’: নাটোরের বাস্তব নারী নাকি কাব্যের প্রতীক?

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কাব্যের ভুবনে এক অনন্য নাম। প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানবজীবনের বেদনা ও দার্শনিকতা সবকিছুর মিশ্রণে তিনি গড়েছেন এক অনন্য কাব্যজগৎ।
বিজ্ঞাপন
তাঁর রচিত ‘বনলতা সেন’ কবিতা, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে, আজও পাঠক ও সমালোচকের কাছে সবচেয়ে আলোচিত এবং জনপ্রিয় সৃষ্টি।
কবিতার প্রথমেই পাওয়া যায় কালজয়ী লাইন- “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে”। এই বাক্য মানবজীবনের দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার প্রতীক হয়ে ওঠে। কবি ইতিহাস, সভ্যতা আর ভৌগোলিক বিস্তৃতি পেরিয়ে চললেও কোথাও খুঁজে পান না শান্তি। অবশেষে নাটোরের এক নারীর কাছে এসে খুঁজে পান বিশ্রামের আবেশ, সেই নারীই বনলতা সেন।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বনলতা সেন কি সত্যিই নাটোরের কোনো বাস্তব নারী ছিলেন, নাকি তিনি শুধুই কবির কল্পনার প্রতীক?
বিজ্ঞাপন
কবিতার বিখ্যাত অংশ- “আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন; আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”
এই লাইন নাটোরের মানুষের মধ্যে গর্বের অনুভূতি জাগালেও সাহিত্যপ্রেমীদের মনে প্রশ্ন তুলেছে, এই চরিত্র বাস্তব নাকি সম্পূর্ণ প্রতীকী?
কবি নিজে বরিশাল, কলকাতা ও দার্জিলিংয়ে বেশি সময় কাটালেও তাঁর কোনো ব্যক্তিগত রচনা বা চিঠিতে নাটোরের সরাসরি উল্লেখ মেলে না। তবুও নাটোরের সঙ্গে এই কবিতার সম্পর্ক স্থানীয় সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে গভীরভাবে। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বনলতা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’, আর নাটোর রাজবাড়ির একটি গেটে খোদাই করা আছে বনলতা সেনের কবিতার অংশবিশেষ।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় কাহিনিতে বনলতা সেনকে ঘিরে নানা গল্প শোনা যায়। কেউ দাবি করেন, ট্রেনে কবির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল; আবার কেউ বলেন, নাটোরের কোনো পরিবারের সঙ্গে কবির যোগাযোগ ছিল। কিন্তু গবেষক ও ইতিহাসবিদরা এসবকে নিছক কল্পকাহিনি বলেই মনে করেন।
সমালোচকদের মতে, বনলতা সেন মূলত এক প্রতীকী চরিত্র। তিনি মানবজীবনের ক্লান্তির শেষে আশ্রয়, মানসিক প্রশান্তি আর শান্তির প্রতিরূপ। যেমন রাতের আঁধারে পথহারা নাবিকের কাছে নক্ষত্র দিশারি হয়, তেমনি কবির জীবনে বনলতা সেনও হয়ে উঠেছেন শান্তির প্রতীক।
আজ নাটোরে বনলতা সেন কেবল কবিতার চরিত্র নন, তিনি শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গর্বের অংশ। বাস্তবে তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে রহস্য থাকলেও সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে তিনি চিরকাল শান্তি, সৌন্দর্য ও আশ্রয়ের প্রতীক হয়ে থাকবেন।


