ছিটমহল বিনিময়ের ৭ বছরে উন্নত জীবনের সান্নিধ্যে দাসিয়ারছড়াবাসী


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


ছিটমহল বিনিময়ের ৭ বছরে উন্নত জীবনের সান্নিধ্যে দাসিয়ারছড়াবাসী

র্দীঘ ৬৮টি বছর অন্ধকারের জীবন থেকে মুক্তির কথা চিন্তা করাই ছিল স্বপ্ন। এক কথাই বন্দিদশায় জীবন-কাঁটতো তাদের। ছিল না চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা। আধুনিক ঘরবাড়ি তো দূরের কথা চলাচলের কোনো রাস্তাঘাটই ছিল না। নদী, খাল, ডোবা এমনকি জমির আইলের ওপর দিয়ে মানুষজন কোনোমতে যাতায়াত করত। চুরি চাপটা করেই পরিচয় গোপন রেখে কিছু বাসিন্দা বাংলাদেশের বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে পড়াশুনা করেছে। কিছু মানুষ পরিচয় গোপন করে ভয় ভয় করে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা নিয়েছেন। এভাবেই চলতো তাদের অবরদ্ধ জীবন। সেই সোনালী স্বপ্ন মাত্র ৭ বছরেই অবসান ঘটেছে সাবেক ছিটমহল বাসিন্দাদের। নাগরিকত্ব পাওয়ার পাশাপাশি ছিটবাসীরা পেয়েছেন আধুনিক জীবন-যাপনের ছোঁয়া।

আজ ৩১ জুলাই। ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের সাত বছর। ২০১৫ সালের এ দিনে মধ্য রাতে দুদেশে থাকা ছিটমহলগুলো স্ব-স্ব দেশের মূল ভূ-খন্ডের সাথে সংযুক্ত হয়। সমাপ্তি ঘটে ১৬২ ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের বন্দিদশা। ছিটমহল বিনিময়ের পর থেকেই বঞ্চিত এ মানুষগুলোকে মূলধারায় যুক্ত করতে বিভিন্ন উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। এই সাত বছরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে ছিটমহলগুলোর। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সামাজিক নিরাপত্বার মতো নাগরীকের মৌলিক অধিকারের সবকিছুই পুরন করেছে সরকার। দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য ছিটমহল গুলোর মতো উন্নয়ন ঘটেছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাশিয়ারছড়া ছিটমহলেও। উন্নয়নের ছোয়ায় পাল্টে গেছে দাসিয়ার ছড়াবাসীর জীবন চিত্র। র্দীঘ ৭ বছরে বদলে গেছে প্রতিটি মানুষের জীবন। ছিটমহল এখন শুধুই ইতিহাস ও অতীত স্মৃতি।

অষ্টমতম বর্ষে পদার্পনে এই ঐতিহাসিক দিনটি ধরে রাখতে বিলুপ্ত ছিটমহলে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। রবিবার ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে কালিরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ৬৮টি মোমবাতী প্রজ্জ্বলন শেষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পন করা বলে জানিয়েছেন সাবেক ছিটমহল আন্দোলনের নেতারা।

বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহলের সবচেয়ে বড় এবং আয়তন ৬ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ হেড কাউন্টিং ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এখানে ১ হাজার ৩৬৪ টি পরিবারের ৬ হাজার ৫২৯ জন মানুষের বসবাস।

প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে ঘরে ঘরে পৌছে গেছে বিদ্যুৎ। ৫৭ কিমি নতুন লাইনে সংযোগ দেয়া হয়েছে ২হাজারেরও বেশি পরিবারকে। পাকা করা হয়েছে ৪০ কিলোমিটার সড়ক। নির্মান হয়েছে ১টি ৩৬ মিটারের ব্রিজসহ ৫ ব্রিজ ও বেশকিছু কালভার্ট। স্থাপিত হয়েছে তিনটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, এমপিও ভূক্ত হয়েছে ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক। মসজিদ, মন্দিরসহ রিসোর্স সেন্টার। ডিজিটাল আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার, এছাড়ার শতভাগ সেচের আওতায় আনা হয়েছে কৃষি জমি। ৩ হাজার ভিজিডিসহ শতভাগ বাড়িতে নিশ্চিত করা হয়েছে সুপেয় পানি ও সেনিটেশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি স্থাপন করেছে ১৫টি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। এ ছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ১৪ টি মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কেন্দ্র। সেখানকার বাসিন্দাদের দেয়া হয়েছে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও স্মার্টকার্ড। এসব উন্নয়নে জীবনচিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে এখানকার মানুষের।

দাসিয়ারছড়া সমন্বয়পাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুর ইসলাম জনবাণীকে জানান, “সম্প্রতি সময়ে সরকার আমার ছিটমহলের ৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও ভূক্ত হওয়ায় আমরা ছিটমহল বাসী চিরকৃজ্ঞ। তাই আমরা ছিটমহলবাসী আজীবন মনে রাখবো এই সরকারকে।”

ছিটমহলের বাসিন্দা ও কালিরহাট বাজারের মুদি দোকানদার লুৎফর রহমান জনবাণীকে জানান, “শেখ হাসিনা সরকার আমাদেরকে ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে সকল নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে। সরকার আমাদের অনেক উন্নয়ন করেছে। আমার এক ছেলে বিনা টাকায় বিনা সুপারিশে বিজিবিতে চাকরি হয়েছে। শুধু আমার ছেলে না ছিমহলের অনেকেই আর্মি,বিজিবিসহ ভাল ভাল স্থানে ও চাকরি করছে। বাংলাদেশ না হলে এটা সম্ভব হতো না। আমরা এখন গর্বের সহিত বসবাস করছি। তাই যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর দোয়া কামানা করেই যাবো।”

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় বাংলাদেশ অংশের দাসিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন জনবাণীকে জানান, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমেই দীর্ঘ ৬৮ বছরের অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ৭ বছরে ছিটমহলের রাস্তা,ঘাট, ব্রিজ-কালভাট,স্কুল-কলেজ,ঘরে ঘরে বিদ্যুতসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আমরা জীবনে ভাবিনী এতো উন্নয়নের ছোয়া পাবো। তিনি আরও জানান, ছিটমহল বিনিময়ের পর বাংলাদেশ থেকে ৬৫টি পরিবারের ১০৭ জন হিন্দু এবং ১০০ জন মুসলিম ভারতে যায়। আমাদের এই কালিরহাট বাজারে একটি মসজিদ আছে। তার ঠিক ১০০ গজ দূরে একটি বড় মন্দির আছে। যে যার ধর্ম পালন করছে। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমরা মুসলিম-হিন্দু মিলে অনেক ভালো আছি। বর্তমান সরকার আমাদের ভালো রেখেছে। তাই এই সরকারের র্দীঘায়ু কামনা করছি।”

ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন দাস জনবাণীকে জানান, “ছিটমহলে ইতিমধ্যে সরকারের নেয়া পরিকল্পনা বেশীরভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। আমাদের যুব সমাজ আইসিটি ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করছে। সম্প্রতি সময়ে সরকার এই ছিটমহলের চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও ভূক্ত করেছে। কয়েক মাস আগে জমি-ক্রয়-বিক্রয়ে জটিলতা থাকলে সেটিও নিরসন হয়েছে। এখন ছিটমহলবাসীরা জমি ক্রয়-বিক্রয় করে রেজিষ্ট্রারীও করতে পাড়ছে। সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের মূল জণগোষ্ঠির সাথে তাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে যা যা করার দরকার তার পদক্ষেপ নেবে সরকার।”

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিটমহল নিয়ে স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ‘মুজিব-ইন্দিরাথ স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি দীর্ঘ সময় নানা কারণে বাস্তবায়ন না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশ পায় এবং সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ারছড়া বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়।

এসএ/