গর্ভবতী স্ত্রী ও শিশুকে হত্যায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ১২ বছর পর গ্রেফতার


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


গর্ভবতী স্ত্রী ও শিশুকে হত্যায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ১২ বছর পর গ্রেফতার

মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুরের চাঞ্চল্যকর গর্ভবতী নিপা ও তার ৩ বছরের মেয়ে জোতিকে শ্বাসরোধে হত্যা মামলার দীর্ঘ ১২ বছর ধরে পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী জাকির হোসেন (৪৭)কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

বৃহস্পতিবার (৪ অগাস্ট) রাতে ঢাকা জেলার সাভার থানাধীন শাহিবাগ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আগামী জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪।

গ্রেফতারকৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদ ও ঘটনার বিবরণ থেকে র‌্যাব জানায়, গত ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ গ্রেফতারকৃত আসামী জাকির হোসেন মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানার জিয়নপুরের একই গ্রামের মোঃ আবু হানিফের মেয়ে নিপা আক্তারের সাথে পারিবারিকভাবে বিবাহ হয়। বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে বেশকিছু নগদ অর্থ, গহণা এবং আসবাবপত্র দেওয়া বরপক্ষকে। বিয়ের পর হতে উগ্র এবং বদমেজাজী আসামী জাকির হোসেন নিপাকে আরো যৌতুকের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকে। এরইমধ্যে জাকির ও নিপার ঘরে জোতি (৩) নামে একটি কন্যা সন্তান জম্মায়। একপর্যায়ে জাকির জানতে পারে পূনরায় তার স্ত্রী নিপা গর্ভবতী। এ ছাড়াও জাকিরের বড় ভাই মোঃ জাহাঙ্গীরের  স্ত্রী তাহমিনার সাথে জাকিরের পরকিয়া প্রেমের সর্ম্পক গড়ে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে দাম্পত্য কলহ আরো বেড়ে যায়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ রাতে জাকিরের ভাই জাহাঙ্গীর বাড়িতে না থাকার সুযোগে আসামী জাকির তার ভাবী তাহমিনার ঘরে প্রবেশ করে। জাকিরের স্ত্রী নিপা আক্তার জাকির ও তাহমিনাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে এবং তার স্বামীকে জানায় বিষয়টি তার ভাসুর জাহাঙ্গীরকে বলে দিবে। সেই কারণে এই বিষয় নিয়ে আসামী জাকির ও তার স্ত্রী নিপা আক্তারের মধ্যে পুনরায় মনোমালিন্য এবং তুমুল ঝগড়ার সৃষ্টি হওয়ায় জাকির তাকে তালাক দেয়ার ভয়-ভীতি দেখায়। তখন নিপা ৫-৬ মাসের অন্তঃসত্তা ছিলো। নিপা জাকির ও তাহমিনার পরকীয়া প্রেমের এই ঘটনা জাকিরের বড় ভাই জাহাঙ্গীরকে বলার পর জাকির, তার ভাই জাহাঙ্গীর, ভাবী তাহমিনা এবং শশুর-শাশুরীসহ প্রায় পরিবারের সকলেই বিষয়টি বিশ্বাস না করে নিপাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরিবারের সদস্য, আত্বীয়-স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবের উস্কানিতে জাকির স্ত্রী নিপার প্রতি আরো উগ্র এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পড়ে এবং গোপনে নিপাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ দিবাগত রাতে জাকির পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঘুমন্ত অবস্থায়  নিপাকে গলায় গামছা দিয়ে হত্যা করে এসময় নিপা মৃত্যু যন্ত্রনায় হাত-পা আছড়া আছড়ি করার সময় তাদের মেয়ে জোতি জেগে কান্না-কাটি করতে থাকে। তখন ঘটনার সাক্ষী না রাখতে পাষান্ড বাবা একই প্রক্রিয়ায় শিশু কন্যাকে হত্যা করে ঘরে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ থানা পুলিশ কর্তৃক নিপা এবং তার কন্যা জোতির মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠায়। একই দিনে চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক ঘটনায় নিপার বাবা মোঃ আবু হানিফ বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় আসামী জাকিরসহ তার বাবা-নইম উদ্দিন শেখ, মা-মালেকা বানু এবং ভাবি-তাহমিনাসহ মোট ৪ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। দৌলতপুর থানা পুলিশ মামলার এজাহারনামীয় প্রধান আসামি জাকির হোসেন, বাবা- নইম উদ্দিন শেখ, মা- মালেকা বানু ও ভাবি- তাহমিনাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়  কিন্তু আসামী নইম উদ্দিন শেখ, মালেকা বানু, তাহমিনা আসামীরা ১ মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পায়। ১ নং আসামী জাকির হোসেন ৫ বছর কারাভোগ করে ২০১০ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার তদন্তকালীন সময়ে স্বাক্ষী-প্রমাণে জানতে পারে এই হত্যাকান্ডে এজাহারনামীয় আসামীদের বাইরেও বেশ কয়েকজন জড়িত আছে। তদন্তকালে আসামী জাকিরের বিচারিক স্বীকারোক্তি অনুযায়ী হত্যাকান্ডের সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় প্রধান আসামী জাকির, তার বাবা নইম উদ্দিন শেখ, মা মালেকা বানু এবং ভাবি তাহমিনা সহ জাকিরের বড় ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন (৩২), জাকিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমিনুল (১৮), জাহাঙ্গীরের শ্যালক স্বপন (২২) ও হাসান (১৮) এবং জাকিরের চাচাতো ভাই পারভেজ @রানা @মিলন (১৫) সহ সর্বমোট ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরবর্তীতে চার্জশিটের ভিত্তিতে আদালত মামলার বিচারকার্য পরিচালনা করেন এবং পর্যাপ্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণ ও উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ভিকটিম অন্তঃসত্তা নিপা আক্তার ও তার মেয়ে জোতি হত্যাকান্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার জেলা ও দায়রা জজ উৎপল ভট্টাচার্য চার্জশিটে অভিযুক্ত হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অপরাধে প্রধান আসামী জাকিরকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন এবং অপর আসামী ভাবি-তাহমিনা, জাকিরের ভাই-জাহাঙ্গীর, জাকিরের বন্ধু-আমিনুল, জাকিরের চাচাতো ভাই পারভেজ রানা মিলন, জাহাঙ্গীরের শ্যালক স্বপন ও হাসান সহ প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। আসামী মালেকা বানু (জাকিরের মা) বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায়  আদালত তাকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। 

উল্লেখ্য যে, বিচারকার্য চলাকালীন সময় আসামী নইম উদ্দিন মৃত্যুবরণ করে। ২০১০ সালে জামিন গ্রহণের পর থেকে মামলার রায়ের সময় মূল আসামী জাকির পলাতক ছিল এবং গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ ১২ বছর আত্মগোপনে ছিলো।

র‌্যাব আরো জানায়, গ্রেফতারকৃত আসামীকে সংশ্লিষ্ট থানায় হন্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।

এসএ/