টিউলিপ ফুল চাষের পাইলট প্রকল্পের অবহিতকরণ সভা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


টিউলিপ ফুল চাষের পাইলট প্রকল্পের অবহিতকরণ সভা

পঞ্চগড় প্রতিনিধি: নেদারল্যান্ড, কাশ্মীর, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক নয় সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামে টিউলিপ ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-ইএসডিও দেশের উত্তরাঞ্চলে টিউলিপ ফুল চাষ সম্প্রসারণের উপযোগীতা নির্নয় শীর্ষক ভ্যালুচেইন পাইলটিং প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়। 

এই প্রকল্পের আওতায় তেঁতুলিয়া উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের চাষী মোছা. মুক্তা বেগম, মোছা. আনোয়ারা বেগম, মোছা. সুমি আক্তার, মোছা. আয়শা বেগম, মোছা. হোসনেয়ারা বেগম, মোছা. মনোয়ারা বেগম, মোছা. মোর্শেদা বেগম ও মোছা. সাজেদা বেগম নামে আট জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী ৪০ শতক জমিতে ৩টি প্লটে লেদারল্যান্ড থেকে আনা ৪০ হাজার বাল্ব রোপণ করা হয়। 

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ইএসডিও’র নির্বাহী পরিচালক জনাব ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান, পরিচালক (প্রশাসন) জনাব সেলিমা আখতার, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলমসহ ইএসডিও ও কৃষি বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দের উপস্থিতিতে টিউলিপ ফুলের বাল্ব (বীজ) রোপণ করা হয়। 

ইএসডিও’র এই প্রকল্পের আওতায় চাষীরা এখানে ৬টি প্রজাতির ১২ কালারের টিউলিপ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্ট্রাকটিকা  (হোয়াইট), ডাচ সানরাইস (ইয়েলো), পারপেল প্রিন্স (পারপেল), টাইমলেস (রেড হোয়াইট শেডি), মিল্কসেক (লাইট পিংঙ্ক), বারসেলোনা (ডার্ক পিংঙ্ক) নামে রংবেরঙ্গে টিউলিপ ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। এছাড়া অ্যাড রেম (অরেঞ্জ), লালিবেলা (রেড). দি ফ্রান্স (রেড), রিপ্লে (অরেঞ্জ), ডেনমার্ক (অরেঞ্জ), স্ট্রং গোল্ডসহ (ইয়েলো) বিভিন্ন প্রজাতির টিউলিপ কলিতে ভরে গেছে প্রতিদিনই নতুন নতুন ফুল ফুটছে বাগানগুলোতে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে সকল কলি ফুলে পরিণত হবে। মাত্র ১৬ দিনের পরিচর্যায় ফুলের কলি আসে। ২০-২১ দিনের মধ্যেই ফুল ফুটতে শুরু করে। ডাটায় কিছু পাতা থাকে। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই ফুল চাষ সহনশীল। এই ফুলের বাল্ব বা বীজ রোপণের দিন হতে ১৮-২০ দিনের মধ্যে কলি আসে এবং ২৫- ৬০ দিন পর্যন্ত এই ফুল স্থায়ী থাকে। 

ইএসডিও চাষীদেরকে এই ফুল চাষাবাদের জন্য নেদারল্যান্ড থেকে টিউলিপ ফুলের প্রতিটি বাল্ব বা বীজ ৬১ টাকা ৮০ পয়সায় কিনে চাষীদের মাঝে বিতরণ করেছেন। বাল্বের পাশাপাশি ইএসডিও চাষীদেরকে প্রকল্প হতে বিনামুল্যে রাসায়নিক স্যার, জৈব সার, খৈল, শেডনেট এবং ফেন্সিংনেট (বেড়ার জাল) দেয়া হয়েছে। এছাড়া চাষীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফুল চাষাবাদে উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। 
চাষীদের পরিবারে আয় বাড়ানো ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, বিদেশ থেকে টিউলিপ ফুল আমদানি নির্ভরতা কমানো, পঞ্চগড় জেলাকে পর্যটন এলাকা হিসেবে উপযোগী করে গড়ে তোলা এবং ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভিত্তিতে উন্নত মানের টিউলিপ ফুল উৎপাদনে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে চাষীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই ইএসডিও’র এই প্রকল্পের লক্ষ্য। বানিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদন করে তাদের উৎপাদিত ফুল যেন নষ্ট না হয় সেজন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এবং গ্রীণ হাউজের ব্যবস্থা করে চাষীদের সহযোগিতা করা, ঢাকাসহ সারাদেশে ফুল সরবরাহে কুলিংভ্যান চালুর ব্যবস্থা করা, ফুল বিক্রিতে ঢাকার ফুল ব্যবসায়ীদের সাথে চাষীদের সমন্বয় করা বা নেগোসিয়েশনের ব্যবস্থা করে উৎপাদিত ফুল বাজারজাতকরণে সহযোগিতা করছে ইএসডিও। 

টিউলিপ চাষাবাদে বাল্ব বা চারার দাম, শেড নেট, ফেন্সিং নেট,  রাসায়নিক সার, জৈবসার, কীটনাশক ও শ্রমের মূল্য বাবদ মোট খরচ প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকা। ৪০ হাজার টিউলিপ ফুল ১শ’ টাকা হারে বিক্রি করতে পারলে ৪০ শতক জমি থেকে মাত্র দুই মাসে ৮ লাখ টাকা আয় করবেন চাষীরা। পরবর্তীতে বছরের অন্য সময়টাতে দেশী বিদেশী বিভিন্ন ফুল চাষাবাদও করতে পারবেন। চাষীরা তাদের ৪০ শতাংশ জমিতে এবারই প্রথম রাজসিক সৌন্দর্য্যরে ফুল টিউলিপ উৎপাদন করে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছেন। তেঁতুলিয়া উপজেলার এই নারী চাষীরা এবছর পরীক্ষামূলকভাবে টিউলিপ ফুল উৎপাদন করে ফুলের জগতে অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছেন। বর্তমানে উৎপাদিত প্রতিটি ফুল বাগান থেকে ১শ’ টাকা দরে স্থানীয়ভাবে বিক্রি শুরু করেছেন তারা। ফুল বাগানে ক্ষুদ্র পরিসরে বিনোদন পার্ক তৈরি করে পর্যটক ও ফুলপ্রেমিদের জন্য প্রবেশ মূল্য চালু করেছেন। এতে করে ফুল বিক্রি বাদেও তারা অতিরিক্ত টাকা আয় করতে পারবেন।

পাইলট প্রকল্পটি সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় ভবিষ্যতে এক হাজার চাষীকে বানিজ্যিকভাবে টিউলিপ ফুল চাষাবাদ সম্প্রসারণের প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা পাবে। এর ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি খাতে যুক্ত হতে পারে টিউলিপ।

উত্তরের শান্ত নিরিবিলি সবুজ শ্যামলিমা পর্যটন এলাকা পঞ্চগড় জেলায় টিউলিপ ফুলের বাগান সৃষ্টি হওয়ায় পর্যটনের আকর্ষণও বেড়েছে। দেশ বিদেশের নানা প্রান্তের লোকজন নানান প্রজাতি ও নানা রংঙ্গের বাহারি টিউলিপ ফুল দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। কেউ সেলফি তুলছেন। আবার কেউ ফুল কিনছেন। দেশে এই ফুলের চাহিদা থাকায় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। উচ্চমূল্যে আমদানির মাধ্যমে এ ফুলের চাহিদা পূরণ করা হয়। নিয়মিত পরিচর্যা, প্রযুক্তি ও কৃষি বিভাগের পরামর্শে চাষীরা প্রথমবারেই সফলতা পেয়েছেন। যেহেতু পরীক্ষামূলক এই ফুল চাষে এখানকার চাষীরা সফল হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে এখানে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চাষীরা বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু করলে লাভবান হতে পারবেন।

ইকো সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বিশ্বাস করেন টিউলিপ ফুল চাষের মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষীদের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক আয় এবং সম্ভাবনা যেমন অনেকাংশে বেড়ে যাবে একিভাবে পর্যটন শিল্পেও তেঁতুলিয়ার যে বিদ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে যে একটি আধার সেটি আরও সম্প্রসারিত হবে এবং এটি এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যতে টিউলিপ চাষ আরও বড় আকারে সম্প্রসারিত করার ইচ্ছা রয়েছে। টিউলিপের বাজারজাত করণের জন্য আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে ফুল ব্যবসায়ীদের প্রকল্প এলাকায় নিয়ে এসে ফুল কেনার বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়া ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলার বিষয়েও বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। 

এসএ/