রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রায় ত্রিশালের আদি নিদর্শন ‘বৈলর রাজ বাড়ি’


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রায় ত্রিশালের আদি নিদর্শন ‘বৈলর রাজ বাড়ি’

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ১৫০ বছর আগের আদি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর নকশা খুচিত কাঠের তৈরী বৈলর জমিদার বাড়ী। স্থানীয়দের কাছে ”রংমহল” নামে পরিচিত। এই আদি নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে।

ময়মনসিংহ শহর থেকে এর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার এবং ত্রিশাল থেকে এর দূরত ৫ কিলোমিটার। নান্দনিক নকঁশা খুচিত দ্বিতল বাড়ীটি পড়ে রয়েছে অযত্নে অবহেলায়।

জানাযায়, ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহের দক্ষিণ অঞ্চল পরিচালিত হত বৈলর জমিদার বাড়ি থেকে। তখন থেকেই ত্রিশালের বৈলর প্রসিদ্ধ ছিল। বৈলর নামকরন হয় জমিদারি আমলে। এর নামকরনের কারন হলো ময়মনসিংহ দক্ষিণের বৈলরের লোকজন তৎকালীন লেখাপড়া করার বেশি সুযোগ পেত। তখনকার লোকজন বই একটার পর একটা লর বেধে রাখত তাই বইয়ের লর কথাটি পরবর্তীতে বইলর হয়ে যায়। তাই এ অঞ্চলের নামকরন করা হয় বৈলর নামে। 

পরগণা জমিদারি স্টেট তথ্য অনুসারে জমিদারের সাথে গোটা রাজ্য পরিচালনার জন্য বৈলরের বেশ কয়েকজন বংশপরক্রমায় জমিদারদের সাথে নিযুক্ত ছিল । বৈলরের সর্বশেষ জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর সাথে একান্তভাবে জড়িত ছিল ত্রিশাল উজান বৈলরের কাদির বক্স সরকার ও তরিপ উল্লাহ সরকার অন্যতম বর্তমান তরফদার বংশের পূর্বপুরুষ। তারা জমিদারের রাজ্য পরিচালনা, দলিল লিখন ও রাজস্ব আদায়ের কাজ পরিচালনা করত। পরবর্তীতে বৃটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশংকায় জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী দেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যাওয়ার সময় তার কাছ থেকে তারা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ক্রয় করেন, এমনকি হেমচন্দ্রের প্রিয় বৈলর জমিদার বাড়ী ক্রয় করেন । 

আরো জানা যায়, তৎকালিন সময়ে এই বাড়ি ক্রয় করার জন্য সাত জন আবেদন করেছিল। জমিদার হেমচন্দ্র সকলকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এই বাড়িটি জমিদার হেমচন্দ্রের কাছে খুবই মায়ামাখা ছিল। হেমচন্দ্র চৌধুরী অবসর সময় কাটানোর জন্য প্রায়শই এই বাড়িতে আসতেন এবং থাকতেন। কাঠের তৈরি এই দ্বিতল বাড়িটি ছিল সুনিপুণ নকশা ও কারুকাজের এক নিদর্শন। এ রাজবাড়িতে দশটি মহল, নাট্যঘর, রংমহল, কারাগার সহ ছিল বেশ কয়েকটি লৌহ সিন্দুক ও ভূমি সংক্লান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। এছাড়াও বাড়িতে জৌলুষ আসবাবপত্র সহ ছিল নানান প্রাণীর সংগ্রহশালা চিড়িয়াখানা। 

সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, জমিদার হেমচন্দ্রের কাঠের তৈরী ”রংমহল” তথা রাজবাড়ী পরে আছে অযত্নে অবহেলায়। জমিদারের রাজ্য পরিচালনা, দলিল লিখন ও রাজস্ব আদায়ের কাজ পরিচালনা করতেন। বর্তমান তরফদার বংশের পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারীগণ ভোগ দখল করছেন। রাজবাড়ীতে প্রবেশের একটি স্টিলের গেইট রয়েছে অনেক ডাকাডাকির পর একজনকে পাওয়া গেল। সে বর্তমান তরফদার বংশের  আবুল মহসিন তরফদারের ছেলে বোরহান উদ্দিন তরফদার ও শরিফ উদ্দিন বকুল তরফদার উত্তরাধিকার সূত্রে এই রাজবাড়ীতে বসবাস করেন। জমিদার হেমচন্দ্রের কাঠের তৈরী দ্বিতল ”রংমহল” রয়েছে আগের মতই কিন্তু তেমন কোন আসবাবপত্র চোখে পড়ে নাই। হেমচন্দ্র যে ঘরে বসবাস করতেন সে ঘরে একটি খাট রয়েছে। যে বারান্দায় বসে থাকতেন তার সুন্দর্যও রয়েছে। দু’তলায় উঠার কাঠের সিড়িটাও আছে। কিছু জিনিস থাকলেও রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। 

জমিদার বাড়ীতে বসবাসরত বোরহান উদ্দিন তরফদার জনবাণীকে জানান, আমার বাব দাদারা জমিদারের কাছ থেকে জমিদার বাড়ী সহ পুকুর, জায়গা ক্রয় করে। জমিদার বাড়ী ৩ একর ২০ শতক জয়গায়, সব মিলিয়ে ৫০ বিঘা তথা ১০ একর জায়গা আছে এখানে। আমার বাবা আবুল মহসিন তরফদারের বংশক্রমে আমরা পেয়েছি জমিদার বাড়ী। এ জমিদার বাড়ীতে প্রায় ৫৭ বছর ধরে বসবাস করছি। জমিদার আমলে রেখে যাওয়া এ বাড়িটি মানুষ রংমহল নামে চিনে। এ জমিদার বাড়িটি কিছু স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করছি। আমি একাই এ বাড়িতে থাকি জমিদারের আদি নিদর্শন গুলো রেখে কিছু কাজ করে থাকার উপযুক্ত করেছি। কাঠ দিয়ে তৈরী দ্বিতল ভবনে জমিদার দুতলায় থাকতেন তার রুম এখনো রয়েছে। অনেক পুরাতন হওয়ার ফলে অনেক অংশই জির্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। জমিদার বাড়ীর ৩০ ইঞ্চি বিশিষ্ট দেয়াল, নৈতকী ঘর, পুকুর, নাট্যঘর ইত্যাদি অনেক কিছু রয়েছে।

২০০৩ সালে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক সফিকুল ইসলাম অতীত ঐতিহ্যের জমিদার বাড়ি সংরক্ষণার্থে অবৈধ দখলকার শরিফুল ইসলাম তরফদার বকুলকে নোটিশ প্রদান করেন। সরকারি জমি ও স্থাপনার অবৈধ দখল ত্যাগ না করায় দখল পুনদ্ধারে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুজ্জামানকে নিয়োজিত করে শরিফুল ইসলাম তরফদার বকুলকে উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দেন। সরকারি ওই সম্পত্তি এখনো উদ্ধার না হলেও আদালতে চলছে মামলা।

স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন, বৈলর রাজবাড়ী ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে ওই বাড়িটি সরকারী ভাবে রক্ষণা-বেক্ষণ করা হলে আগামী প্রজন্ম জমিদারদের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। জমিদারের পুরনো এই কীর্তিটি সংরক্ষণ করা গেলে পর্যটকদের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকবে। এটি এ অঞ্চলের একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রুপান্তরিত হবে।

এসএ/