তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন জরুরি
জনবাণী ডেস্ক
প্রকাশ: ০১:০৮ পূর্বাহ্ন, ২৮শে সেপ্টেম্বর ২০২২
সাদিকুর সাদিক: বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তথ্যের প্রয়োজনীয়তা ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে তার ব্যবহার প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এক অন্য উচ্চতায় ছিয়েছে যা আমাদেরকে তথ্য সম্পর্কে ধারনায় পালটে দিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে তথ্য অধিকার জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে ২০০২ সালের ২৬ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর তথ্য অধিকার ও তথ্যের অবমুক্তি আইন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক বৈঠকে ২৮ সেপ্টেম্বর কে ‘আন্তর্জাতিক জানার অধিকার দিবস’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল রাইট টু নো ডে’ হিসেবে ঘোষণা করে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তথ্য পাবার অধিকারকে মূল্যায়ন করে দিনটি পালন করে থাকে। এই দিনটা পালনের মাধ্যমে জনগণের তথ্য পাবার অধিকারকে বাস্তবায়নের জন্য গনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করেন। প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর দিনটি "আন্তর্জাতিক জানার অধিকার দিবস’ আমাদের দেশে যথাযথভাবে পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় “তথ্য আমার অধিকার- জানা আছে কি সবার” এবং ¯শ্লোগান “তথ্য আমার অধিকার, জানতে হবে সবার” যার যথাযথ বাস্তবায়ন আশা করছি। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশে ২০০৯ সালে গৃহিত ‘তথ্য অধিকার আইন’ নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক। এই আইন অনুযায়ী ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর ধারা ৪ অনুসারে কর্তৃপক্ষের নিকট হতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য পাবার অধিকার রয়েছে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁকে তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য।
এই আইনের যথাযথ প্রয়োগের জন্য যাবতীয় বিধিবিধান প্রণনয়ন করা হয়েছে, ফলে তথ্য পাবার জন্য দেশের জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগ করে যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য পাবার জন্য আবেদন করে যেকোনো প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান তথ্য দিতে আপত্তি করে তাহলে তাকে শাস্তির আওতায় আনার বিষয়েও নীতিমালা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যকলাপ জনগণের কল্যাণে পরিচালনা করা হয়ে থকে । তথ্য যদি একটা সম্পত্তি হয় তাহলে সেই সম্পত্তিতে জনগণের অধিকার রয়েছে। এই তথ্য আইন প্রনয়নের উদ্দেশ্য হলো জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে প্রতিটি কাজের জবাবদিহি ও সচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং জনগণকে সাথে নিয়েই যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন করা। জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হলে সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারী ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারী সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে, দুর্নীতি কমে যাবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বড় বড় দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থ পাচার সহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড তথ্য গোপন রাখার ফলেই হয়ে থাকে কেননা সেখানে জবাবদিহিতা থাকে না। তাই জনগণ যদি এসব ব্যাপারে তাদের তথ্য অধিকার দাবি করেন তখন তা প্রকাশ পেয়ে যাবে এবং ফলশ্রুতিতে অসচ্ছতার প্রমাণ পাওয়া যাবে এবং জবাবদিহির একটা জায়গা সৃষ্টি হবে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমানে এই তথ্য অধিকার আইন বলবত থাকলেও তা উল্লেখযোগ্য কোনো ফল বয়ে আনতে পারিনি দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য। একদিকে যেমন এই আইনের প্রচার-প্রসারের অভাব, অন্যদিকে তেমন রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা, যার ফলে সাধারন জনগণ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনের সুফল যথাযথ ভোগ করতে পারছে না।
ডিজিটাল যুগে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য ওয়েবসাইটে দেয়া থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু আমাদের দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বিধিবদ্ধ সংস্থার যাবতীয় তথ্য ওয়েবসাইটে নামমাত্র দেয়া থাকলেও প্রয়োজনীয় সব তথ্য পাওয়া যায় না এবং তা নিয়োমিত হালনাগাতও করা হয় না, যা এই ডিজিটাল দেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের পাশাপাশি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অভাবে কাংখিত সেবা না পাওয়ার করন হয়ে ছাড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ অফিস, নির্বাচন কমিশন অফিস সহ সকল অফিসে সেবা গ্রহনের ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্যের অভাবে যে ভোগান্ত শিকার হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। অল্পশিক্ষিত বা অজ্ঞ লোকেরা তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগে জটিলতা দেখে তা থেকে পিছিয়ে আসেন। নিজের তথ্য অধিকার আদায়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
এছাড়াও রয়েছে অফিসের কিছু আভ্যন্তরিক অযৌক্তিক নিয়ম কানুন, আর এই নিয়ম কানুনের চক্করে পরে অশিক্ষিত জনগণ বিড়ম্বনার স্বীকার হন। একদিকে যেমন দাপ্তরিক তথ্য দিতে কর্মকর্তা অনিহা দেখান , অন্যদিকে রয়েছে দালালের দৌড়াত্ব যা আমাদের ভোগান্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বলা হয় দেশের সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দালালের আতুর ঘর। কোনো সেবা গ্রহণ করতে গেলে সেই সেবা গ্রহণের উপায় সংক্রান্ত নিয়ম কানুন জানা অশিক্ষিত লোকজনের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। আর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই দালালেরা সুবিধা নিয়ে থাকেন। দালালের কাছে অর্থের বিনিময়ে কাজ করাতে বাধ্য হন। এছাড়া দালালদের সংঘবদ্ধ কর্মকান্ডের কাছে সাধারণ জনগণ অসহায় বোধ করেন। এসব কাজে সরকারী কর্মচারী, কর্মকর্তা জড়িত থাকেন বলেও জানা যায়। ফর্ম পূরন ,বিল প্রদান, আবেদন দেয়া সহ যাবতীয় কাগজ পত্রের কাজে লেখালেখিতে ভুল বা অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হলে সাধারণত তা অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। যথাযথ তথ্য বা দিক নির্দেশনার অভাবে অনভিজ্ঞ লোকদের এসব ভূল হয়ে থাকে যা সেবা পেতে বিভিন্ন জটিলতার করন হয়ে দাঁড়ায় । এসব ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্য পাবার অধিকার নিশ্চিত হলে ভোগান্তি অনেকাংশেই কমে যাবে এবং দালালের সরণাপন্ন হবার প্রয়োজন পড়বে না।
নির্ধারিত সেবা পাবার জন্য যথাযথ দিক নির্দেশনা সম্বলিত কোনো পোস্টার বা সাইনবোর্ড কাঙ্খিত সেবা পাবার জন্য খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। ।এছাড়া এমন ক্ষেত্রে সরকারী দায়িত্বশীলগণ যদি সঠিক তথ্য যথাযথ উপস্থাপন করেন তাহলে সেবা পেতে ভোগান্তি অনেকাংশে কমে যাবে। নির্ধারিত সেবার জন্য যাবতীয় তথ্য গ্রাহকদের জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংবলিত পোস্টার বা সম্ভব হলে বুথের ব্যবস্থা করা তথ্য অধিকার দিবসের উল্লেখযোগ্য দাবি বলে মনে করি। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসে তথ্য অধিকার নিশ্চিত কল্পে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় তথ্যকে মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার আহবান করছি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
জেবি/