জিয়াউর রহমানের সবুজ বিপ্লব এবং তারেক রহমানের ভাবনা: ডনেল ডানিয়েল কস্টা
জনবাণী ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬:০৬ অপরাহ্ন, ২৮শে ডিসেম্বর ২০২৪
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এর পর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় । ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ঘোষক এবং রনাঙ্গনের জেড ফোরসের সবাধিনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্তে আসেন। যুদ্ধ বিধস্ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কবলিত এবং অর্থনৈতিক ভাবে সঙ্কটে থাকা একটি দেশ তখন পুনর্গঠনের জন্য নেতার অপেক্ষায় ছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহামান সেই সংকটের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের অসহায় সম্বলহীন মানুষের মাঝে এক নতুন আশার সঞ্চার করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো কৃষি। কারন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই তিনি কৃষি খাতের উন্নয়নকে কেন্দ্র করে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল খাল খনন কর্মসূচী এবং কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের আন্দোলন।
ওনার লক্ষ্য ছিল:
১। খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা
২। সমস্ত রাস্তার দু’ধারে ফলের গাছ লাগানো
৩। রাস্তার দু পাশের ঢালুতে শাকসবজির চাষাবাদ করা
৪। সমস্ত পুকুরে মাছের চাষ করা এবং
৫। প্রত্যেক ঘরে ঘরে হাঁস মুরগীর খামার করা ।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহামানের কৃষি খাতে এই প্রকল্প গুলো কেবল খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, বরং তিনি এই কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশের মানুষকে একত্রিত করে একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে তা দারিদ্র বিমোচন ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে এক মাইলফলক হবে। আর এই কারণেই তিনি এ ধরণের সাহসী ও ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যা পরবর্তীতে কৃষি ও অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে।
আরও পড়ুন: অনির্বাচিতরা দীর্ঘদিন থাকলে অপকর্মে জড়ানোর শঙ্কা
ঐ সময়ে খাল খননের কর্মসূচি ছিল দেশের কৃষি খাতে পানি সংকট সমাধানের একটি অন্যতম পদক্ষেপ। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ হলেও শুষ্ক মৌশুমে অনেক অঞ্চলেই পানির অভাব দেখা দিত, যা কৃষির উপর এক বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলত। এতে সঠিক সময়ে সেচের অভাবে অনেক কৃষক ফসল ফলাতে পাড়তেন না।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খাল খনন কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানি সংরক্ষণ এবং সেচে সহজ লভ্যতা আনায়ন করা। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে ১,৫০০ এর বেশি খাল খনন এবং পুনঃ খনন করা হয়। যা প্রায় ২৬ ০০০ কি মি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ সমস্ত খাল খনন ছিল এক ধরনের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিপ্লব। তখন গ্রামীন জন গোষ্ঠীকে এক কাতারে আনা গিয়েছিল এবং সকলে দল বেঁধে খাল খনন করতে উৎসাহী হয়েছিল। তার এই খাল খননের প্রভাব পড়েছিল বাংলাদশের কৃষি খাতে। খালের মাধ্যমে সেচ দেয়ার পরিমান বেড়েছিল আশানুরুপ ভাবে। এতে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ বহন করতে হয়নি কৃষকদের।
জরিপে দেখা গিয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সালে মোট ৩২ লাখ ২ হাজার ২৫০ একর জমি সেচের আওতাধীন ছিল। যার মধ্যে ১৫ লাখ ৩৯ হাজার ১৩০ একর জমিতে পাওয়ার পাম্প ও টিউবওয়েল এর মাধ্যমে সেচ দেওয়া হতো। আর খালের মাধ্যমে সেচ দেওয়ার পরিমান ছিল মাত্র ২ লাখ ৯৩ হাজার ৮৪০ একর জমি। বাকি জমিতে প্রচলিত পধতিতে সেচ দেওয়া হতো।আর ১৯৮১ সাল থেকে ৮২ সালে মোট আওতাধীন ছিল ৪০ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৭ একর জমি। সে সময় খাল থেকে সেচ দেওয়ার পরিমান ছিল ৪ লাখ ৩ হাজার ৫১৫ একর জমি। এই উদ্দোগের ফলে কৃষকরা শুষ্ক মৌশুমে সেচ দেবার সবিধা পান। যা তাদের ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য ভাবে বারিয়ে দেয়। বিশেষ করে ধান সহ অন্যান্য খাদ্য উতপাদনে ব্যাপক উন্নতি হয়। সাধিত হয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। এই কর্মসূচির সুফল ১৯৮০ র দশকে স্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হয়। এই খাল গুলি নদী থেকে বয়ে আনত প্রচুর পরিমানে পলি, যা মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়িয়ে দিতো। বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে খাবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার পথে এগিয়ে যায়। যা দারিদ্র বিমোচনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভুমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন: শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড
জনাব তারেক রহমান গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জেনিয়ারিং ইন্সিটিউট এ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের এক আলচনা সভায় একটি চমৎকার পরিকল্পনার কথা বলেছেন। তিনি কথা দিয়েছেন ক্ষমতায় গেলে পুনরায় খাল খনন কর্মসূচি গ্রহন করবেন। যা আমাকে তথা সমগ্র দেশবাসীকে বিশেশভাবে আলোড়িত করেছে। কেননা আমার জন্ম ৮০ র দশকে এবং শৈশব বেড়ে ওঠা খাল তীরবর্তী গ্রামে। শৈশবের সেই প্রমত্তা খাল আর এখনকার জরাজীর্ণ খাল আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখছি মাটির উর্বরতা, দখল হতে দেখছি খাল গুলোকে। সেচ ব্যবস্থাপনায় বিরাজ বিরাজ করছে চরম বিশৃঙ্খলা। সেচে এত খরচ বেরেছে যে, অনেক কৃষক চাষ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে অনেক জমি অনাবাদী থেকে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে শস্য উৎপাদন, আর সেই সাথে খাবার ঘাটতি মেটাতে দেশকে হতে হচ্ছে আমদানি নির্ভর। যা আমাদের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পরছে। জনাব তারেক রহমান খাল খননের কয়েকটি যৌক্তিক কারন উল্লেখ করেছেন-
১। কৃষকের পানি প্রাপ্তির সহজলভতা
২। ভু-গরভস্ত পানির চাপ কমানো
৩। পানির রিজার্ভ তৈরি করা
৪। বন্যা নিওন্ত্রন করা এবং
৫। মানুষের প্রাত্যহিক কাজে পানির ব্যাবহার নিশ্চিত করা সহ নানাবিধ কারন উল্লেখ্য।
সম্প্রতি দেশের পূর্বাঞ্চলে স্মরণ কালের ভহয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল। স্থল ভুমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানির নিচে তলিয়ে যায়। বান ভাসি মানুষ গাছে ও আশে পাশের উঁচু জায়গায় আস্রয় নেয়। দেখা দেয় চরম মানবীয় সঙ্কট। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। নদী বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে চিন্তা করা অসম্ভব। বর্তমানে অনেক নদী অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে মাতৃতুল্য নদী আজ ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে নদীগুলো মানুষের জীবন ও জিবিকার সাথে একাকার হয়ে মিশেছিল। বিগত সময়ে বিভিন্ন নদী ভরাট করে শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিলাসী প্রমোদ বাংলো বাড়ী, বিনোদন কেন্দ্র, ক্লাব তৈরি করে নদী-খাল গুলোর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করে নদী গুলো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নদী মাতৃক দেশ আজ ইতিহাসে স্থান পাচ্ছে, বাস্তবে নয়।
আরও পড়ুন: ভারতের পানিতে বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্কারী বন্যা ও প্রাসঙ্গিক কথা
১৮ কোটি মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলো হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এখন প্রশ্ন, জাতি আজ কি এতে উপকৃত হয়েছে। জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তার জন্য তদন্ত করা হোক। ঐ সকল দখলকারী ও দুসরদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির পদক্ষেপ নেওয়া হোক। একই সাথে জাতীয় ভূমি নকশা অনুসারে বাংলাদেশের প্রতিটি নদ নদী ও খাল রক্ষা ও সীমানা নিশ্চিত করা হোক। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক যুগান্তকারী পদক্ষেপ খাল খনন প্রকল্প ও নদী খনন প্রকল্প গুলো চলমান থাকলে প্রতি বছর বন্যার তিব্রতা থেকে এই দেশের মানুষ রক্ষা পেত। কাজেই দেশের খাল গুলো পুনঃ খনন এবং নতুন খাল খনন করে প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সময়ের বাস্তব দাবী।
এমএল/