কিশোর গ্যাং এর হামলায় লিখন হত্যা মামলার মূলহোতা সহ ৪ জন গ্রেফতার
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০:৪৫ অপরাহ্ন, ১২ই অক্টোবর ২০২২
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। খুন, ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতার এবং জঙ্গীবাদের মত ঘৃণ্যতম অপরাধ নির্মূল ও রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি মাদকদ্রব্য উদ্ধার, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারসহ নেশার মরণ ছোবল থেকে তরুন সমাজকে রক্ষা করার জন্য র্যাবের জোড়ালো তৎপরতা অব্যাহত আছে।
র্যাব-৪ বিগত দিনগুলোতে কিশোর গ্যাং অপরাধ নির্মূলে সাফল্যজনক অভিযান পরিচালনা করেছে যার মধ্যে আশুলিয়ার চাঞ্চল্যকর খাদেমের পায়ের রগ কাটা মামলার আসামী কিশোর গ্যাং রাকিব-ইমন গ্রুপের লিডার রাকিব ও ইমনকে গ্রেফতার, পল্লবীর চাঞ্চল্যকর জাহিদ হত্যা মামলার আসামী কিশোর গ্যাং ইফরান গ্রুপের লিডার ইফরানসহ ০৪ জনকে গ্রেফতার এবং পল্লবীর চাঞ্চল্যকর এসএসসি পরীক্ষার্থী রাকিব হত্যাচেষ্টা মামলার আলোচিত কিশোর গ্যাং জুনিয়র গ্রুপের প্রধান রমজান ও আল আমিনসহ ০৫ জন কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতারসহ র্যাব-৪ কর্তৃক গত কয়েকমাসে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল ১১ অক্টোবর ২০২২ রাতে ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানার বিভিন্ন এলাকায় সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করে চাঞ্চল্যকর লিখন হত্যা মামলার আলোচিত কিশোর গ্যাং গ্রুপের লিডার মোঃ রনি (১৯) সহ তার অপর তিন সহযোগী রাকিব (১৮), মোঃ জিলানী (১৮) এবং মোঃ সোহাগ (১৯)’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
মামলার এজাহার পর্যালোচনা, গ্রেফতারকৃত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং এই মামলার স্বাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায় যে, আশুলিয়া থানাধীন পলাশবাড়ি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং মাদকের অপব্যবহারসহ নানা অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাং কালচারের প্রবণতা রয়েছে। সেখানে কাইচ্চাবাড়ি গ্যাং এবং গোচারটেক ভাই বেরাদার গ্যাং নামে দুটি পৃথক কিশোর গ্যাং রয়েছে যারা এলাকায় ইভটিজিং, ছোটখাট ছিনতাই, মাদক সেবন ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সার্বক্ষণিক দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকে। গ্রেফতারকৃত আসামী রনি কাইচ্চাবারি কিশোর গ্যাং গ্রুপের লিডার এবং তার দলে ১০/১৫ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
ভিকটিম মেহেদী অপর কিশোর গ্যাং গোচারটেক ভাই বেরাদার গ্যাং গ্রুপের সদস্য এবং নিহত ভিকটিম লিখন মেহেদীর বন্ধু এবং পূর্ব পরিচিত। ঘটনার কিছুদিন পূর্বে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোচারটেক ভাই বেরাদার গ্যাং গ্রুপের কয়েকজন সদস্য কাইচ্চাবাড়ি গ্যাং এর সদস্য আদর’কে মারধর করে। বিষয়টি আদর কাইচ্চাবাড়ি কিশোর গ্যাং লিডার রনি’কে জানালে রনি এবং তার গ্রুপ এই ঘটনার প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা করে। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ০৪ জুলাই ২০২২ তারিখ সন্ধ্যা আনুমানিক ০৬.৩০ ঘটিকার সময় আশুলিয়া পলাশবাড়ি গোচারারটেক ইস্টার্ন হাউজিং মাঠের পাশে লোহার রড ও ধারালো দেশীয় অস্ত্রসহ রনির দল অবস্থান করে। সেসময় ভিকটিম মেহেদী’কে আকস্মিকভাবে ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে যেতে দেখে ধৃত আসামী রনি ও তার কিশোর গ্যাং গ্রুপ মেহেদীর পথরোধ করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে বেদম মারপিট করতে থাকে।
ঘটনস্থলের অদুরে মৃত ভিকটিম লিখন (১৮) মাঠে বসে মোবাইল ব্যবহার করছিল। এসময় তার বন্ধু ভিকটিম মেহেদী’কে মারধর করতে দেখে তার জীবন বাচাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে মেহেদী’কে বাচানোর চেষ্টা করে। এসময় কাইচ্চাবাড়ি কিশোর গ্যাং সদস্যরা রনি’র নেত্বেত্বে ভিকটিম মেহেদীর সাথে ভিকটিম লিখনকেও এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে। এক পর্যায়ে আসামীদের লোহার রডের আঘাতে ভিকটিম লিখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে হামলাকারীরা গুরুতর আহত লিখন এবং মেহেদী’কে ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে দ্রæত পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণ গুরুতর আহত অবস্থায় ভিকটিমদ্বয়’কে উদ্ধার করে ভিকটিম লিখন’কে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে এবং অপর ভিকটিম মেহেদী’কে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান।
আহত ভিকটিম মেহেদী চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেও অপর গুরুতর আহত ভিকটিম লিখন গত ০৫ জুলাই ২০২২ তারিখ সকালে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুরণ করেন। এ ঘটনায় ভিকটিমের চাঁচা শরীফুল ইসলাম বাবু বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় ধৃত আসামী রনি, এনায়েতসহ অজ্ঞাতনামা আরো অনেকের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন যার মামলা নং-১৮, তারিখঃ ০৫ জুলাই ২০২২, ধারাঃ ১৪৩/৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩০২/৩৪ দন্ডবিধি। উক্ত সংবাদটি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা হলে আশুলিয়া-সাভার কেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় যার ফলশ্রুতিতে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব-৪ উক্ত চাঞ্চল্যকর হত্যা ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে ও জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
ঘটনার পর থেকেই কাইচ্চাবাড়ি গ্রুপের কিশোর গ্যাং লিডার রনিসহ অন্যান্য আসামীরা দিনাজপুর, রংপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠি ও গাজীপুরে আত্মগোপনে ছিল এবং এসময় তারা কোন মোবাইল ফোন ব্যবহার করেনি। একপর্যায়ে তাদের টাকা-পয়সা শেষ হয়ে গেলে টাকা-পয়সা সংগ্রহের জন্য গোপনে আশুলিয়া এলাকায় এলে র্যাব-৪ এর চৌকস টিম গোপন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত আসামীরা সকলেই উক্ত ঘটনায় নিহত ভিকটিম লিখন ও অপর ভিকটিম মেহেদী’কে মারমিটের সাথে জড়িত মর্মে র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
গ্রেফতারকৃত প্রধান আসামী গ্যাং লিডার রনি ২০০২ সালে ঢাকার আশুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করে গত ১৮ বছর ধরে আশুলিয়া এলাকায় পরিবারের সাথে বসবাস করে আসছে। সে আশুলিয়ার স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে আশুলিয়ার একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। তার পিতার বাইপাইল আড়তে মাছের দোকান রয়েছে। সে গার্মেন্টেসে কাজের পাশাপাশি কাইচ্চাবাড়ি গ্যাং এর লিডার হিসেবে প্রকাশ্যে ইভটিজিং, ছিনতাই, মাদক সেবনসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে মারামারিসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত। মাদকসেবী হওয়ায় মূলত মাদকের অর্থ যোগানের জন্য নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত।
গ্রেফতারকৃত আসামী জিলানী ২০০২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানাধীন এলাকায় জন্মগ্রহণ করে গত ১২ বছর ধরে আশুলিয়া এলাকায় পরিবারের সাথে বসবাস করে আসছে । সে আশুলিয়ার স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে মায়ের সাথে আশুলিয়ার একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। তার বাবা মৃত। সে গার্মেন্টেসে কাজের পাশাপাশি কাইচ্চাবাড়ি গ্যাং এর নেতৃত্বস্থানীয় সদস্য হিসেবে প্রকাশ্যে ইভটিজিং, ছিনতাই, মাদক সেবনসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে মারামারিসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত।
গ্রেফতারকৃত আসামী সোহাগ ২০০২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানাধীন এলাকায় জন্মগ্রহণ করে গত ১৫ বছর ধরে আশুলিয়া এলাকায় পরিবারের সাথে বসবাস করে আসছে । সে আশুলিয়ার স্থানীয় একটি স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তার পিতা রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে সে লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাইচ্চাবাড়ি গ্যাং এর নেতৃত্বস্থানীয় সদস্য হিসেবে প্রকাশ্যে ইভটিজিং, ছিনতাই, মাদক সেবনসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে মারামারিসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত।
গ্রেফতারকৃত আসামী রাকিব ২০০২ সালে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানাধীন এলাকায় জন্মগ্রহণ করে গত ১২ বছর ধরে আশুলিয়া এলাকায় পরিবারের সাথে বসবাস করে আসছে। সে নিরক্ষর এবং বর্তমানে বাইপাইলে একটি মাছের আড়তে কাজ করে। তার পিতা এলাকায় কোয়েল পাখির ব্যবসা করে এবং মা গার্মেন্টসকর্মী। সে মাছের আড়তে কাজ করার পাশাপাশি কাইচ্চাবাড়ি গ্যাং এর সদস্য হিসেবে প্রকাশ্যে ইভটিজিং, ছিনতাই, মাদক সেবনসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তাারে মারামারিসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত।
কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে র্যাব-৪ এর কার্যক্রমঃ বর্তমানে রাজধানীতে বহুল আলোচিত বিপদগামী কিশোর গ্যাং বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী, চাদাবাজী, ছিনতাই, নারীদের ইভটিজিংসহ মাদক সেবন ও ব্যবসায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, ধর্মীয়, নৈতিক শিক্ষাসহ পারিবারিক বন্ধন জোরদারের বিষয়ে আরো যত্নবান হওয়ার লক্ষ্যে র্যাব-৪ তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকার স্কুল-কলেজে এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনার পাশাপাশি কিশোর-তরুণদের গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিশোর গ্যাং কালচার রোধে র্যাব-৪ এর এরুপ প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম এবং বিপথগামী কিশোর অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের’কে প্রয়োজনীয় আইনানুগ কার্যক্রমের জন্য আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। এছাড়াও উক্ত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত অন্যান্য পলাতক আসামীদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিশোর গ্যাং এর অন্যান্য গ্রুপের বিষয়েও অনুসন্ধান চলমান, কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই ধরনের কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে র্যাবের জোড়ালো অভিযান অব্যাহত থাকবে।
আরএক্স/