ভাসমান বেডে সবজি চাষ কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
মো. রুবেল হোসেন
প্রকাশ: ০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন, ৪ঠা নভেম্বর ২০২২
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার চর পালরদী গ্রামের কৃষক শাহীন রাড়ী ও জুলহাস মিয়াসহ অনেকেই পাঁচ বছর ধরেই ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। এবার ভাসমান বেডে সবজি চাষ করছেন লাউ শশাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি। প্রতিটি সারিতে প্রায় ২০ মিটার লম্বা ভাসমান বেড প্রস্তুত করে তাতে চাষ করছেন ফসল।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বদ্ধ জলাশয়ে ভাসমান বেডে বিশেষ পদ্ধতিতে নানা জাতের সবজির চাষাবাদ। পানির উপরে মাচায় ঝুলে আছে নানা জাতের শীতের আগাম সবজি। নৌকা নিয়ে বাগান থেকে সবজি তুলছেন কৃষকরা।
জানা যায়, ছোট ছোট বেড কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করে সেখানে চাষ হচ্ছে ঢেঁড়স, বরবটি, লাউ, কুমড়া, লালশাকসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি। সার কিংবা কীটনাশক ছাড়াই বর্ষা মৌসুমে বছরের প্রায় ৬ মাস এ পদ্ধতিতে চাষ করা যায়।
কৃষকরা বলছেন, বিগত কয়েক বছর ধরে তারা ভাসমান এই পদ্ধতিতে সবজির চাষ করছেন। এর ফলে কম খরচে উৎপাদন বেশি হওয়ায় লাভও ভালো পাচ্ছেন চাষিরা। অনেকে এক মৌসুমে ৪০-৫০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করছেন।
জলাবদ্ধ জমিতে যেখানে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে চাষ করার কোনো সুযোগ নেই সেখানে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ অর্গানিকভাবে এই সবজি উৎপাদিত হয় বলে জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। চাষ হচ্ছে বিষ মুক্ত সবজি।
প্রকল্প পরিচালক ড. বিজয় কৃষ্ণ বিশ্বাস জনবাণী কে বলেন, 'পতিত জমির সঠিক ব্যবহার হচ্ছে একই সাথে পুষ্টিকর নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর সবজি এবং মসলা উৎপাদন হচ্ছে চলমান এই প্রকল্পে। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে জৈবিক বালাইনাশক ব্যবহার করে যাচ্ছে কৃষকরা এতে নিরাপদ সবজি নিশ্চিত হচ্ছে'।
ভাসমান বেডে যে সকল সবজি চাষ হয় তা লাউ শশাসহ বিভিন্ন প্রজাতির শীতকালিন সবজি, এছাড়াও সারাবছর ভাসমান পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসল ও মসলা উৎপাদন করছে কৃষক।
আধুনিক পদ্ধতিতে ভাসমান বেডে যে সকল সবজি চাষ হয় তা খেতে অনেক সুস্বাদু। ভাসমান বেডে ২ থেকে ৩ টা ফসল চাষের পর ব্যবহিত কচুরিপানা ও বিভিন্ন আগাছার জৈব সার হিসেবে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে ব্যবহার করা হয়। এতে করে কৃষকের অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়না।
বিষ মুক্ত এসব সবজি চাষ করে কৃষক লাভবান হচ্ছে। কালকিনি উপজেলার চর পালকদি গ্রামের কৃষক মোঃ শাহীন রাড়ী,মোঃ ইমন, মোঃ ইমরান ও মোঃ জুলহাস মিয়া জনপ্রিয় এই প্রকল্পের মাধ্যমে সারাবছর চাষ করছে বিষ মুক্ত সবজিসহ নানান ধরনের ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক ড. মোঃ সাইফুল ইসলাম জনবাণী কে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ১ ইঞ্চি জমিও পতিত রাখা যাবেনা তার বাস্তব প্রমাণ হলো ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প। এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানায়, যারা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন এই চাষ পদ্ধতিকে বাস্তবায়ন করছে'। সারাদেশের জলাভূমি প্রর্যাক্রমে এই প্রকল্পের মাধ্যমে চাষের আওতায় আসবে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তিনি আরও বলেন,'আমরা আশা করি বিষ মুক্ত নিরাপদ ফসল চাষে কৃষি বিপ্লব ঘটবে'। বর্ষার মৌসুমে তথা সারাবছরই জলাবদ্ধ পতিত জমি ব্যবহারে একমাত্র ভাসমান বেডে সবজি চাষ প্রকল্প কাজ করছে। বর্ষা মৌসুমে যে সকল জলাধার বা জলাবদ্ধ এলাকায় কৃষক বেকার সময় পার করতো সে সকল এলাকার কৃষক এখন ভাসমান বেডে সবজি চাষের মাধ্যমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এতে কর্মসংস্থনের সৃষ্টি হচ্ছে বেকারত্ব দুর হচ্ছে। একই সাথে মহিলাদের কাজেরও সৃষ্টি হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
ভাসমান বেডের সাথে অর্ধভাসমান পদ্ধতি, বস্তা পদ্ধতি, ঢালি পদ্ধতি, ড্রাম পদ্ধতি, ডাইক পদ্ধতি, প্যারামিড পদ্ধতিসহ ইত্যাদি ভাবে জলাবদ্ধ ও জলমগ্ন পতিত জমিতে চাষ হচ্ছে।
দেশের ৪৫ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জলসীমা রয়েছে। এই জমির ১০-২০ শতাংশ জমিতে যদি ভাসমান সবজির আবাদ করা যায় তাহলে দেশের সবজি ও মসলা উৎপাদনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। পরিবর্তিত জলবায়ুর অভিযোজন কৌশলে পরিবেশবান্ধব উপায় ভাসমান সবজি ও মসলা চাষ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এ পদ্ধতির চাষাবাদে তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না।