আশুগঞ্জ বন্দরে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭:২৫ পূর্বাহ্ন, ২৮শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩


আশুগঞ্জ বন্দরে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য
আশুগঞ্জ বন্দর। ছবি: জনবাণী

নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের আশুগঞ্জ বন্দরে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানার জন্য সারা দেশে সুপরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা। 


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর দেশের অন্যতম ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আশুগঞ্জ সার কারখানা থেকে সার যাচ্ছে আওয়াতাভুক্ত সাত জেলায়। 


তারা আরও জানান, আশুগঞ্জের বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার-কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাণিজ্য হচ্ছে।


ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেঘনা নদীর তীরের এই শহর এখন পুরো জেলার অর্থনীতির লাইফলাইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত নদী বন্দরের কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব ব্যবসায় প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে ৫০ কোটি টাকারও বেশি। আর কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ১৫ হাজার মানুষের।


৬৭ দশমিক ৫৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের আশুগঞ্জ উপজেলাটি চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে ছোট উপজেলা। এই উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী ঘিরে গড়ে ওঠা নৌবন্দর পাল্টে দিয়েছে অর্থনীতি ও এখানকার মানুষের জীবনমান।


জনশ্রুতি রয়েছে, ১৮৯৮ সালে আশুগঞ্জের গোড়াপত্তন হয়। মেঘনার তীরে পাট ও আউশ ধান বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে গঞ্জ গড়ে ওঠে। সেই থেকেই নামকরণ হয় আশুগঞ্জ। আর এই মেঘনা নদীকে ঘিরে যেসব ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে ধান ও চাল অন্যতম। এ দুই ব্যবসায় প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে ১৫ কোটি টাকারও বেশি।


মেঘনার ভিওসি ঘাটে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে ধানের বাজার বসছে। ধানের এই বাজারকে দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মোকাম ধরা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও আশপাশের অন্তত ৭ জেলার কৃষকের ধান মোকামে নিয়ে আসেন বেপারিরা।


প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই ধানের ক্রেতা-বিক্রেতার হাকডাকে মুখর হয়ে ওঠে ভিওসি ঘাট। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে ধান কেনাবেচা। মোকামে বিভিন্ন জাতের ধান পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম বিআর-২৮, বিআর-২৯, বিআর-৪৯ ও বিআর-২২। দৈনিক ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার ধান বেচাকেনা হয় আশুগঞ্জ মোকামে।


এছাড়াও ধানের মোকাম ঘিরে আশুগঞ্জে সারা বছরই জমজমাট থাকে চালের ব্যবসা। জেলায় চাতাল কল আছে প্রায় দুইশ যার অর্ধেকেরও বেশি আশুগঞ্জে। এসব চালকল থেকে প্রতিদিন ১০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের চাল বাজারজাত হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। চাতালগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের।


আশুগঞ্জ উপজেলা চাতাল কল মালিক কাজী আসাদ বলেন, ধানের মোকাম ঘিরে আমাদের চালের ব্যবসাও ভালো চলে। প্রতিদিন অন্তত ১০ কোটি টাকার চাল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হয়। সরকারের সহযোগিতা ও ব্যাংকগুলো যদি সহজ শর্তে ঋণ দেয়, তাহলে ধান-চালের ব্যবসা আরও প্রসারিত হবে। পাশাপাশি আরও বহু মানুষের কর্মের সংস্থান করা যাবে।’


এদিকে, নদীবন্দর ঘিরে আশুগঞ্জ ফেরিঘাটে গড়ে চাঙা হয়ে উঠেছে সার, রড ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা। এসব ব্যবসায়ও প্রতিদিন বড় অঙ্কেও লেনদেন হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও নারায়াণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এসে ভিড়ে আশুগঞ্জ নদীবন্দরে। জাহাজ থেকে ট্রাকে পণ্য লোড এবং আনলোড কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১ হাজার শ্রমিকের। একেকজন শ্রমিক দিনে আয় করেন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।


ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মূলত সড়ক, নৌ ও রেলপথ সংযুক্ত হওয়ায় বাণিজ্য বসতি গড়ে উঠেছে আশুগঞ্জে। ব্যবসায়ীরা নৌবন্দর ব্যবহার করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসার জন্য পণ্য আনতে পারছেন। এছাড়া, বন্দরে আসা বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য সড়ক ও নৌপথে সহজে পাঠানো যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব পণ্য পরিবহনে গড়ে উঠেছে পরিবহন ভাড়ার ব্যবসাও। প্রতিদিন কয়েকশ ট্রাকবন্দও থেকে পণ্য নিয়ে ছুটে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে।


তবে যে নদীবন্দর গতিশীল করেছে পুরো জেলার অর্থনীতিকে, সেখানে লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পর আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে ২০০৮ সালে আশুগঞ্জ নৌবন্দরকে ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো এ নৌবন্দর ব্যবহার করে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পরিবহণ করা হয় ভারতের ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল।


পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের নৌপ্রটোকল চুক্তির আওতায় আরও কয়েক ধাপে আশুগঞ্জ নদীবন্দর ও আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হয়েছে।


তবে নদীবন্দরে মাত্র দুটি জেটি থাকায় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। এছাড়া, বন্দরের একমাত্র ওয়্যারহাউজটি তেরি হয়েছিল ভারতীয় পণ্য রাখার জন্য। ফলে এটিও ব্যবহার করতে পারছেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি নেই কোনো ডকইয়ার্ড।


আশুগঞ্জ শহর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি গোলাম হোসেন বলেন, ভৌগলিক অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় আশুগঞ্জ এখন পুরো জেলার ব্যবসা কেন্দ্র। প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন ব্যবসায় লেনদেন হচ্ছে ৫০  কোটি টাকা। এই হিসাবে বছরের ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সব কিছুই হয়েছে নৌবন্দরের কারণে। তাই নৌবন্দরটির যদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যায় তাহলে বাণিজ্য বেড়ে দ্বিগুণ হবে।


এ বিষয়ে আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজার নদীবন্দরের উপ-পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, ‘আশুগঞ্জে একটি কন্টেইনার টার্মিনাল পোর্ট করা হচ্ছে। এই পোর্ট থেকে সরাসরি মোংলা ও চট্টগ্রাম থেকে অভ্যন্তরীণ পথে কন্টেইনারগুলো আশুগঞ্জে আসবে। এখানে জেটি যেমন থাকবে, তেমনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্য ওঠানামার সুবিধাও থাকবে।’


রেজাউল করিম বলেন, ‘এছাড়া আমরা এখানে মডার্ণ কার্গো জেটি করছি। যেখানে পণ্য ওঠানামার পাশাপাশি সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই কাজগুলো শুরু হবে।