ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নবীনগর ৪টি ও বাঞ্ছারামপুরে ৮টি অরক্ষিত বধ্যভূমি


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১:৫৩ অপরাহ্ন, ৩রা এপ্রিল ২০২৩


ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নবীনগর ৪টি ও বাঞ্ছারামপুরে ৮টি অরক্ষিত বধ্যভূমি
স্মৃতিসৌধ

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পশ্চিমে নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দুটি উপজেলায় কী পরিমাণ সাধারণ মানুষকে পাক বাহিনী হত্যা করেছিল তার হিসেব নেই। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গবেষক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও সাহিত্য একাডেমির কবি জয়দুল হোসেনের গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ বইয়ে নবীনগর উপজেলায় ৫টি এবং বাঞ্ছারাপমপুর উপজেলায় ৮টি বধ্যভূমির তথ্য পাওয়া যায়।


নবীনগর উপজেলায় ৪টি বধ্যভূমির তথ্য পাওয়া যায়, বধ্যভূমির মধ্যে রয়েছে (এক) খারঘর বধ্যভূমি, নবীনগর উপজেলাধীন বড়াইল ইউনিয়নের খারঘর গ্রামে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ৫১ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বড়াইল ও খারঘর গ্রামে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিল। ১০ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে প্রায় দিনব্যাপী গ্রামটির ওপর চালানো হয়। ঐসময় পাশর্^বর্তী গ্রাম থেকে ধরে এনে লোকজনকেও হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়। গ্রামের প্রায় সর্বত্র লাশের স্তুপ পরিণত হয়।


(দুই) নবীনগর হাই স্কুলের দক্ষিণ পাশে একটি খেলার মাঠে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা লোকজনকে নির্যাতনের পর হত্যা করে একটি পুকুরের পাশে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে হত্যা করে পুকুরের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। পুকুরের মধ্যে কয়েক দফা গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭১ সালে প্রায় নির্জন এই এলাকাটি বৃহৎ একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে পুকুরটির কিছু অংশ ভরাট করে খেলার মাঠের এলাকা বাড়ানো হলেও বধ্যভূমির স্থানটি চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। (তিন) নবীনগর থানা বাউন্ডারির ভিতরে পুকুরপাড় বধ্যভূমি, নবীনগর থানা ভবনের পশ্চিম পাশে পুকুরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণায় ঝোপঝাড়ের আড়ালে কয়েক দফা গণহত্যা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে নিয়ে থানা ভবনের একটি কামড়ায় আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। ওখানে কয়েক দফা গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এলাকাটি বৃহৎ একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। (চার) ইবরাহিমপুর-বিল বধ্যভূমি, নবীনগর উপজেলাধীন ইবরাহিমপুর বিলে কয়েক দফা গণহত্যা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে এনে হত্যা করে লাশ বিলের পানিতে ফেলে দেয়া হতো।


বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ৮টি বধ্যভূমির তথ্য পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে মডেল থানার পশ্চিমে বধ্যভূমি, (এক) মুন্সিগঞ্জ কাঠপট্টি এলাকার সম্ভাব্য হিন্দু পরিবার, নারী পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী তিতাস নদীতে লঞ্চযোগে আগরতলা যাত্রাপথে বাঞ্ছারামপুর থানা ঘাটে পাক-বাহিনীর হাতে নির্মম পাশবিক অত্যাচার ও ধর্ষণ করে হত্যা করে। তাদেরকে থানার পশ্চিমে গণকবর দেয়া হয়। (দুই) দশদোনা বধ্যভূমি, ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসে দশদোনা এলাকায় আক্রমণ করে পাঁচশত ঘর বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয় এবং ১৭ জন সাধারণ জনগণকে পাক বাহিনী হত্যা করে। পরবর্তীতে স্থানীয় জনগণ লাশগুলোকে দশদোনা কবরস্থানে কবর দিয়ে দেয়। (তিন) উজানচর বধ্যভূমি, উচানচর ইউনিয়নের কংশ নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্বদিকে নদীর ঘাটে ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা নদীতে ডুবে মারা যায় এবং ৩ জন সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে নদীর ধারেই কবর দেয়া হয়। (চার) দূর্গারামপুর বধ্যভূমি, বর্তমান পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের দূর্গারামপুর গ্রামে নদীর ঘাটে মুক্তিযুদ্ধে ১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ বরণ করেন, ১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা নদীতে ডুবে মারা যায় এবং সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে নদীর ধারেই কবর দেয়া হয়। (পাঁচ) আছাদনগর বধ্যভূমি, বর্তমান পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের আছাদনগর গ্রামে যুদ্ধের সময় ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং তাকে নদীর তীরেই কবর দেয়া হয়। (ছয়) দড়িভেলানগর বধ্যভূমি, ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়ন দড়িভেলানগর যুদ্ধের সময় ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং ঐ গ্রামের কবরস্থানে তাকে কবর দেয়া হয়। (সাত) রূপসদী বধ্যভূমি, রূপসদী ইউনিয়নের জমিদার বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ক্যাম্প ছিল। যুদ্ধকালীন এ গ্রামের সাধারণ জনগণসহ অন্যান্যদের ওপর পাক বাহিনীরা পাশবিক আক্রমণ চালায় এবং তাদেরকে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। স্থানীয় জনগণ জীবন ভয়ে পালিয়ে ছিল দীর্ঘদিন। পরবর্তীতে শহিদদের কবরস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। (আট) কৃষ্ণনগর বধ্যভূমি, বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের কাচারীর সামনে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু লোককে এখানে ধরে এনে হত্যা করে লাশ তিতাস নদীতে ফেলে দেয়া হত । 


কৃষ্ণনগর কাচারী ভবনে আটক রেখে অনেককে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। এর মাঝে অক্টোবরের শেষ দিকে পার্শ্ববর্তী হোমনা ও নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা কয়েকশ লোককে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ৫ অক্টোবর কৃৃষ্ণনগর এলাকার ১০ জনকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে এখানে অন্তত ৩টি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। তিতাস নদীর মধ্যে সারিসারি লাশ ভেসে যেতে দেখেছে এলাকাবাসী। বাঞ্ছারামপুরের পার্শ্ববর্তী উপজেলা হোমনার (কুমিল্লা) ঘাঘুটিয়া ইউনিয়নের নালা দক্ষিণ গ্রাম থেকে ২৫ জন অজ্ঞাত পরিচয় লোককে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী কৃষ্ণনগর বধ্যভূমিতে হত্যা করে। কয়েক মাসে এখানে কয়েকশ লোক গণহত্যার শিকার হয়েছে।


আরএক্স/